কম মজুরিতে ইটভাটায় কাজ করছে শিশুরা

শিশুশ্রম আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ‘বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন-২০০৬’ অনুযায়ী ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দুরবস্থা হচ্ছে শিশুশ্রমের প্রধান কারণ। লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে, সংসারের অসচ্ছলতার গ্লানি দূর করতে পরিবার থেকেই শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করা হয়।

লেখাপড়া বাদ দিয়ে টানাপড়েনের সংসারে ভরণপোষণ চালাতে বাধ্য হয়ে অধিকাংশ ইটভাটায় কম মজুরিতে কাজ করে শিশুরা। লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায় ঘুরে দেখা যায়, উত্তপ্ত রোদে ইট বানানোয় ব্যস্ত সময় পার করছে শিশু শ্রমিকরা। তাদের বেশিরভাগের বয়স ১৫ বছরের কম। তারা বলছে, অভাব-অনটনের কারণেই ইটভাটায় কাজ করছে তারা।

এখানকার একটি ইটভাটায় ইট বানানোর কাজ করছে মাত্র ১২ বছর বয়সী মো. আফিফ (ছদ্মনাম)। অভাবের কারণে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে। আফিফের কথায়, ‘আব্বার যদি টাকা-পয়সা থাকতো, তাহলে তো আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে আর এখানে কাজ করতাম না। আব্বা নিজেই আমারে এইখানে একরকম বিক্রি করে দিয়া গেছে। গত চার বছর ধরে আমি ব্রিক ফিল্ডে ইট বানানোর কাজ করি। প্রথম বছর অনেক কষ্ট হইছিল, এখন সহ্য হয়ে গেছে। এখানে অনেক বন্ধুবান্ধব ও হয়ে গেছে। গত চার বছরে বাড়ির চেয়ে এই ফিল্ডেই বেশি সময় কাটছে।’

আরিফ জানায়, গতবছর ছয় মাস কাজ করাবে বলে তার বাবার সঙ্গে এককালীন ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়েছে। কিন্তু তা সাত মাসেরও বেশি হয়েছে। পরে অল্প কিছু টাকা দিয়ে তার বাবাকে কোনোরকম মানিয়ে নিয়েছে। ছোট এই শিশুর ভাষ্যমতে, ইটভাটায় তাদের দৈনিক নূন্যতম ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সেই অনুযায়ী দৈনিক গড়ে ৩০০ টাকার ও কম বেতন পায়। 

বড়দের হিসাব আবার তাদের থেকে আলাদা। বড়দের এই একই কাজের জন্য ছয় মাসের চুক্তিতে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। সেই হিসাবে তারা দৈনিক ৬০০ টাকার মতো বেতন পায়।

এ বিষয়ে কথা হয় আফিফের বাবার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অসুস্থতার কারণে আগের মতো কাজকর্ম করতে পারি না। চাষবাস করে এতোদিন সংসার চালাতাম। অসুস্থতার কারণে ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছি। উপায় না দেখে আমার ছোট ছেলেরে ব্রিক ফিল্ডে ছয় মাসের জন্য দিয়েছি। সে ছোট, এজন্য তার মজুরি কম, বড়দের বেশি। অথচ ছোট-বড় সবাইকে একই কাজ করতে হয়। কোম্পানির দেওয়া টার্গেট মতো ইট বানাতে হয়। কোম্পানির টার্গেট পূরণ যতোদিন না হবে, ততদিন কাজ করতে হবে।’

কথা হয় ১১ বছর বয়সী রিসাদ (ছদ্মনাম) নামের আরেক শিশু শ্রমিকের সঙ্গে। সেও অভাবের কারণে ইটভাটায় কাজ করে। পড়াশোনায় আফিফের মতো তারও প্রাইমারির গন্ডি পেরোনো হয়নি। তার বাবা মাত্র ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছয় মাসের জন্য তাকে কাজে দিয়েছে। রিসাদ জানায়, কাজের সময় ঝড়-তুফান, অসুখ-বিসুখ কোনও বাহানাতে রেহাই হবে না। কাজ করতেই হবে। তিন বেলা কোনোরকম খাওয়া আর দুইটা লুঙ্গি বা প্যান্ট দিয়েই কাজ শেষ করায়। ছয় মাসের কথা বলে তার বেশিও কাজ করায়। অসুস্থ শরীর নিয়েও কাজ করতে হয়। 

এই শিশুর ভাষ্য, ‘এই নিয়ে প্রতিবাদও করা যায় না। কিছু বললে বলে— তোর বাপ আমাদের কাছে তোরে ছয় মাসের জন্য বিক্রি করে দিছে। এখন এই ছয়মাস তুই আমাগো। আমরা যা বলি, তোর তাই করতে হইবো।’

কথা বলতে বলতেই চোখ ভিজে যায় ছোট্ট রিসাদের। সে বলে, ‘ঠিকমতো কাজ না করলে ম্যানেজারের মার খাইতে হয়। আব্বার কাছে বিচার দিলে বলে— কাজ না করলে তো মারবেই। মায়ের কাছে বলেও লাভ হয় না। গত তিন বছর ধরেই এখানে কাজ করতেছি। অল্প টাকা বেশি টাকা আমার ভাগে কিছুই থাকে না। সব তো আব্বুরে দেয়। আমি শুধু কাজই করি। টাকার হিসাব আমার কাছে নাই। সপ্তাহে আমাকে হাত খরচের জন্য কিছু টাকা দেয় তা দিয়েই আমার চলে।’

রিসাদের বাবার কাছে ছেলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বীকারও করেন তিনি। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘অভাবে না থাকলে কখনোই নিজের ছেলেকে দিয়ে এমন কষ্টের কাজ করাতাম না। এক মেয়ে বিয়ে দিয়ে যৌতুক দিতে দিতে আমি নিঃস্ব। নিজের অসুস্থতা, বউয়ের অসুস্থতা; সব মিলিয়ে আমার একার কামাই দিয়ে আর সংসার চলে না। তাই অল্প টাকাতেই ছেলেটারের ব্রিক ফিল্ডে কাজ করতে দিয়েছি। অন্যান্যদের তুলনায় আমার ছেলে ছোট, তাই টাকাও অনেক কম দেওয়া হয়েছে।’

এসব বিষয়ে কথা হয় রামগতির আর জে ব্রিকফিল্ডের ম্যানেজার আলতাব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ইচ্ছে করে কোনও শিশুকে এসব কাজে জড়াতে চাই না। কিন্তু অনেক পরিবার থেকে তাদের বাবারা আমাদের কাছে এসে হাতেপায়ে ধরেন, তাদের ছেলেকে কাজ দেওয়ার কথা বলেন। আমরাও দয়া-মায়া করে তাদের ছোটখাটো কাজ দেই। তবে এর মধ্যে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে, সেগুলোতে আমরা তাদের যেতে দেই না। সেগুলোতে সম্পূর্ণ পূর্ণবয়স্ক ও অভিজ্ঞরা করেন। ছোট বা অন্যান্য যারা আছে, তারা ইট বানানোর কাজ করেন।’

শিশুদের কম পারিশ্রমিকের বিষয়ে তিনি বলেন, শিশুরা তো বড়দের মতো কাজ করতে পারে না। তাই বড়দের মতো একই সময় দিলেও তাদের কম বেতন।’