ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ক্ষোভ সম্পাদক পরিষদের

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। সংগঠনটি বলেছে, ২০১৮ সালে প্রণয়নের পর থেকে এই আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এই আইন গণমাধ্যমের ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করছে। মঙ্গলবার (২ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৩ উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকাশক্তি’ শীর্ষক আলোচনায় সভায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আজ আমরা বলছি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ  শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করছে। কিন্তু কতটুকু মালিকপক্ষ করছে, কতটুকু করপোরেট কোম্পানিগুলো করছে তা দেখি না। টেলি কোম্পানিগুলো দ্বারা গ্রাহকরা বিভিন্নভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছে, কিন্তু আপনারা তা লেখেন না। কারণ তারা আপনাদের বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যুক্ত না।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু

তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা ও সংশোধন দরকার। অনতিবিলম্বে তথ্যমন্ত্রীর কথা শুনে কোন কোন জায়গায় সংশোধন লাগবে সেগুলো করে ফেলা দরকার। এটা ঝুলিয়ে রাখা ঠিক না।

দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, আমার এখন কথা বলতে ভয় লাগে। কারণ মিস ইন্টারপ্রেট (ভুল ব্যাখ্যা) করে। তিনি বলেন, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ আজ নতুন কিছু না। যুগে যুগে সব শাসকরাই সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে এসেছেন। বিভিন্ন সময় ইত্তেফাক পত্রিকাও বন্ধ করা হয়েছিল। সবসময় যারা রাষ্ট্র চালায় বা যাদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তাদের দ্বারাই কণ্ঠরোধ করা হয়। আমরা বাঙালিরা সবসময়ই সংগ্রাম করেছি, করে যাচ্ছি।

দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন

নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, যারা মুক্তভাবে মত প্রকাশ করতে চায় ও স্বচ্ছভাবে দেশের অসঙ্গতিগুলো পত্রিকায় তুলে ধরতে চায় তারাই এর (ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন) ভিকটিম। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে ভিন্ন মত পোষণ করা যায় না। অনুনয়-বিনয় করে কোনও লাভ নেই। আমরা সরকারের সঙ্গে বহুবার কথা বলেছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে, কিন্তু কিছুই বদলায়নি। এ আইন হয়েছে।

সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, বড় বড় দেশে যখন কোনও আইন হয় তখন ছোট দেশগুলোতে সেটার কপি হয়। কতিপয়ের কাছে অধিকাংশ গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ। তেমনি নানা ধরনের  আইন ও বিধিনিষেধ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। সত্যের পক্ষে যখন সাংবাদিকরা দাঁড়াবে তখন পৃথিবীও সাংবাদিকদের পক্ষে দাঁড়াবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮৩ শতাংশ ভুক্তভোগী হচ্ছে নারীরা। আর ২৭ শতাংশ ভুক্তভোগী হচ্ছে সাংবাদিকরা।

তিনি আরও বলেন, শুধু আইনের দোহাই দিলেই হবে না। এখন পেশাদার সম্পাদক আর মালিকের সম্পাদকের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। কে পেশাগত কাজ করছে আর কে মালিকের স্বার্থের জন্য কাজ করছে সেটাও বুঝতে হবে।

সমকালের সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, আমরা যারা সাংবাদিকতায় কাজ করছি আমরা জানি কী অবস্থায় কাজ করছি। সাংবাদিকতা পেশাই আজ বিপদজনক হয়ে উঠেছে। পেশাটাকে রক্ষা করার জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। পাকিস্তান আমলে সংবাদপত্রের  স্বাধীনতার জন্য আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আমাদের সেই লড়াই করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকার অনেক সময় বলে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা আছে। শহর ও গ্রাম থেকে হাজার হাজার পত্রিকা বের হচ্ছে। সংখ্যা যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মানদণ্ড হতো তাহলে পঙ্গপাল হতো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী। সংখ্যা দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নির্ধারণ করা ভুল।

ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সরকারের মধ্যেও এই আইন নিয়ে অস্বস্তি আছে। তারা বলছে এটা সংশোধন করবে, কিন্তু করছে না।

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম

সভাপতির বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন,  ২০১৮ সালে আইন প্রণয়নের সময় বলা হয়েছিল এগুলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না। কিন্তু পাঁচ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ আইন প্রয়োগ হচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে।

এসময় তিনি চারটি দাবি জানান। দাবিগুলো হচ্ছে­-

১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা। বাতিলে যদি প্রতিবন্ধকতা থাকে সেক্ষেত্রে একটি ক্লজ যুক্ত করা যে আইনটি স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রযোজ্য নয়।

২. এই আইনে যে সব সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে সেগুলো বাতিল করা।

৩. ভয়ের সংস্কৃতি দূর করাতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়া।

৪. হুইসেল ব্লোয়ারদের রক্ষা আইন করা।

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ সংগঠনের সাংবাদিক নেতারা।