অসুস্থতা যেন পুলিশ সদস্যদের নিত্যসঙ্গী

দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ বাহিনী। আইনি যেকোনও সমস্যা, সংকট বা বিপদে নাগরিকদের প্রথম ভরসা বাংলাদেশ পুলিশ। নাগরিকদের নিরাপত্তায় শহর থেকে গ্রামে সবখানে দিনরাত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন পুলিশ সদস্যরা। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, পুলিশ আছে জনতার পাশে’ এই স্লোগান নিয়ে নানা ধরনের সেবা দিচ্ছে বাহিনীটি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশে সৃষ্টি করা হয়েছে নানা ধরনের ইউনিট। তবে যানবাহন, স্বাস্থ্য, জনবল ও লজিস্টিকসহ নানা সংকটে জর্জরিত বিশাল এই বাহিনী। সেসব সংকট নিয়েই বাংলা ট্রিবিউনের সিরিজ প্রতিবেদন ‘পুলিশের কষ্ট’।

অতিরিক্ত কাজের চাপ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক পুলিশ সদস্য নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। টানা ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টাও কাজ করতে হয় অনেক পুলিশ সদস্যকে। অসুস্থ হলে সব সময় ছুটি কিংবা সুষ্ঠু চিকিৎসাও মেলে না। এভাবেই কাটিয়ে দিতে হয় চাকরি জীবন। পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ফ্লু, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, নাক ও কানের সমস্যা, হৃদরোগ ও জ্বর নিয়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী হাসপাতালে আসেন। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, নাক ও কানের সমস্যা এবং জ্বর নিয়েই হাসপাতালে আসেন বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য।

দেবাশীষ কর্মকার কাজ করেন রাজধানীর একটি থানায়। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রাত নেই, দিন নেই, কাজ করে যেতে হয়। চাকরির ধরনটাই যেহেতু এমন, সে কারণে কোথাও কোনও অভিযোগ করারও জায়গা নেই। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাঝে-মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে পারি না।’

মোফাজ্জল হোসেন (৪৫) পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন ১৯৯৮ সালে। তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুর। দীর্ঘদিনের কর্মজীবনে কাটিয়েছেন রাঙামাটি,  মুন্সীগঞ্জ এবং র‌্যাব-১০ এ। সর্বশেষ কর্মরত আছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে। পরিবার ছাড়া একাই কর্মস্থলে বসবাস করেন। বাইরের ও মেসের মানহীন খাবার, অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন— সব মিলিয়ে এ বয়সে এসে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন মোফাজ্জল। উচ্চ রক্তচাপও আছে তার।

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা বাইরে টহলে থাকি। মাঝেমধ্যে আরও বেশি সময় থাকতে হয়। এসময় চাইলেই গিয়ে থানায় খাওয়া যায় না। তখন বাইরে কোনও ফুটপাতের রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেই। এসব খাবার প্রতিদিনই একবার করে খাওয়া পড়ে। এই খাবার খেয়ে শরীরে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছু করার নেই, ক্ষুধা পেলে খেতে হয়। আমি যখন মুন্সীগঞ্জে ছিলাম— একবার অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে এসে ভর্তি হই। টানা এক সপ্তাহ এখানে ভর্তি ছিলাম। ওই সময় ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন— যেন প্রতিদিন সময় করে বিশ্রাম নেই। প্রতিদিনই ওষুধ খেতে হয়। শরীর এখন আর চলে না। বিশ্রাম নিতে মন চাইলেও সেই সুযোগ নেই। দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। যেকোনও ওষুধের প্রয়োজনে রাজারবাগ হাসপাতালে যাই। ওখানে যেতে পারলে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়।’

রাজধানীর সূত্রাপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রবিউল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘প্রায় দিনই ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। দেখা গেছে, সকাল ৯টায় থানায় আসলাম, কোনও কোনও দিন কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত ১টা থেকে ২টা বেজে যায়। আবার ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। আবার সকাল ৯টায় অফিসে আসি। দুপুরের খাবার বিকালে, আর রাতের খাবার মধ্য রাতে, এই অনিয়মেই অসুস্থ হয়ে পড়ি প্রায়ই। নানামুখী ক্লান্তির কারণে থানায় আসা লোকজনকে সবসময় ভালো সেবাও দেওয়া যায় না।’

ফরিদপুর জেলার মধুখালী গ্রামের পান্নু মিয়া স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে। ট্রাফিক কনস্টেবল হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন ১৯৮৪ সালে। গোপালগঞ্জ, খুলনা, রাঙামাটিসহ বিভিন্ন জেলায় কাজ করে এখন রাজধানীতে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০০ সালে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন উপসহকারী পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই)। ২০০২ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন। ওই আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পা এখনও সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেনি তার। ভাঙা পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ২০০৯ সাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

তিনি জানান, দুর্ঘটনার সময় ছিলেন মাদারীপুরে। সেখানে সরকারি একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছি। বর্তমানে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজারবাগ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন পুলিশ সদস্যরা। সেখানে সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।

কনস্টেবল মাহমাদুল ইসলামের বাড়ি বগুড়া সদরে। এক ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। ১৯৯৫ সালে পুলিশে যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ডিউটি করে ক্লান্ত হয়ে যাই। এরপরও দায়িত্ব তো পালন করতে হবে। একবার অসুস্থ হয়ে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম এক সপ্তাহের মতো। স্বাস্থ্যের যেকোনও সমস্যার সব ওষুধই দেওয়া হয় সেখানে। বাইরে ডাক্তার দেখিয়েও সেখানে গেলে প্রয়োজনীয় সব ওষুধ রাজারবাগ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়।’

রাজারবাগ পুলিশ কেন্দ্রীয় হাসপাতালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও পরিদর্শন) মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সব সমস্যা কাটিয়ে বর্তমানে সুশৃঙ্খলভাবে হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে এখানে। প্র‍তি মাসে আমরা ৫৭ হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছি। তুলনামূলকভাবে মাঠ পর্যায়ে যেসব পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন, তারাই বেশি আসছেন। এছাড়া পুলিশ পরিবারের সদস্যরাও চিকিৎসা নিতে আসেন।’

সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতিরিক্ত কাজের চাপে যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। এছাড়া দীর্ঘ সময় কাজ করলে কাজের কোয়ালিটিও থাকবে না। সাধারণ মানুষকে সার্ভিস দেওয়ার ক্ষেত্রটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাপ আমাদের থাকবেই। কিন্তু অতিরিক্ত চাপ হলে তা পেশাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় কাজ করলে যেকোনও লোকই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। একজন পুলিশ সদস্যের এক্ষেত্রে আরও বেশি ঝুঁকি রয়েছে। ৮ ঘণ্টার বেশি লাগাতার কাজ করলে কোনও লোকের ব্রেনই কাজ করবে না। এজন্য শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য তাদের ছুটি ও নির্ধারিত কর্মঘণ্টা থাকা উচিত।’

আরও পড়ুন: