গুলশান হামলার ৭ বছর

এখনও তাড়া করে ফেরে সেই স্মৃতি

রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার সাত বছরপূর্তি আজ  ১ জুলাই। আলোচিত এই ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের এখনও তাড়া করে ফেরে ভয়াল সেই স্মৃতি। নারকীয় এই জঙ্গি হামলার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অনেকেই বলছেন, এখনও মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নের মতো সেই স্মৃতি ফিরে আসে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসাটা এখনও তাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় নব্য জেএমবির একটি সশস্ত্র দল। জঙ্গিদের হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই সদস্যসহ ২২ জন প্রাণ হারান। পরদিন ২ জুলাই সকালে অপারেশন থান্ডারবোল্ট নামে কমান্ডোদের এক অভিযানে পাঁচ জঙ্গির লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে এক রেস্টুরেন্ট কর্মীর লাশ উদ্ধার ও পালিয়ে বের হয়ে আসার পর হাসপাতালে আরেক রেস্টুরেন্ট কর্মীর মৃত্যু হয়।

আলোচিত এই ঘটনাটি নিয়ে সে সময় দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিট একযোগে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসির ধারাবাহিক অভিযানে গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া নব্য জেএমবির শীর্ষ একাধিক নেতা মারা যায়। গ্রেফতার করা হয় অনেক শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আলোচিত এই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, তার তদন্ত শেষ করে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। অভিযোগপত্রে মোট ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে অপারেশন থান্ডারবোল্ট ও অন্যান্য অপারেশনে অভিযুক্তদের মধ্যে ১৩ জন নিহত হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে থাকা আট জন হলো, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদীসুর রহমান সাগর, রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শেষে আলোচিত এই ঘটনার রায় হয় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রায়ে ৮ জঙ্গির মধ্যে সাত জনের ফাঁসির আদেশ দেন। মিজানুর রহমান নামে এক জঙ্গির সম্পৃক্ততা আদালতের যুক্তিতর্কে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়।

ডেথ রেফারেন্স শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে

আলোচিত এই জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিম্ন আদালতের রায়ের চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দোষীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, অধস্তন আদালতের রায়ের পর এর ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয়েছে উচ্চ আদালতে। গত ১৪ মে উচ্চ আদালতে এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শুরু হয়। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ প্রথমে রায়ের অংশ পড়ে শোনান। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। সর্বশেষ ১৪ জুন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়। পরে দ্বিতীয় বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান হজ পালন করতে সৌদি আরব যান। আপাতত শুনানি থেমে আছে। নিয়মানুযায়ী তিনি দেশে ফিরে যোগদান করলে ওই বেঞ্চেই ফের আলোচিত এই মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হবে।

এখনও তাড়া করে ফেরে সেই স্মৃতি

আলোচিত এই হামলার ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া হলি আর্টিজান বেকারির কর্মী আকাশ খান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঘটনাটা ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মতো। এখনও মাঝে মধ্যে সেই স্মৃতি মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। ঘুমের ঘোরেও মাঝে মধ্যে সেই স্মৃতি তাড়া করে ফেরে।’

আকাশ জানান, ওই ঘটনায় অন্যান্য রেস্টুরেন্ট কর্মীর সঙ্গে তাকেও একটি বাথরুমে আটকে রাখা হয়। ভোরের দিকে যখন তাদের বাথরুম থেকে বের করা হয়, তখন রেস্টুরেন্টের ফ্লোরে অগণিত লাশ দেখে থমকে যান। তিনি মনে করেছিলেন, সন্ত্রাসীদের পুলিশ হঠিয়ে দিয়েছে। এক জঙ্গিকেই তিনি ভুলবশত সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্য মনে করে—সন্ত্রাসীদের কিছুই করতে পারলেন না কেন বলে প্রশ্ন করেছিলেন। তখন সেই জঙ্গি তাকে বলেছিল—তারা নিজেরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

আকাশ বলেন, তখন আমার রক্ত হিমশীতল হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছে, জঙ্গিরা আমাকেও মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। ওই ঘটনায় প্রাণ নিয়ে ফেরা আকাশ বলেন, ‘এত বড় একটা ঘটনার পর যে এখনও বেঁচে আছি, এটা এখনও আমার কাছে অলৌকিক মনে হয়।’

হলি আর্টিজান বেকারির আরেক শেফ শিশির সরকার বলেন, ‘ওই ঘটনা আর মনে করতে চাই না। ওটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ একটা দিন। জীবন হাতে নিয়ে অস্ত্রের মুখে আমি জঙ্গিদের রান্না করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। মিথ্যা বলে জীবন বাঁচিয়েছি। এখনও সেসব স্মৃতি মনে পড়লে স্বপ্ন মনে হয়।’

শিশির সরকার জানান, জঙ্গিরা হামলার পর এক জাপানি নাগরিকের সঙ্গে তিনি চিলার রুমে পালিয়েছিলেন। কিন্তু অত্যধিক ঠান্ডার কারণে সেখানে টেকা যাচ্ছিল না। জঙ্গিরাও তাদের চিলার রুম থেকে বের করার জন্য কসরত করছিল। রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে জঙ্গিরা তাদের বের করার পর জাপানি লোকটাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তিনি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী হওয়ায় তাকে অন্যদের সঙ্গে আটকে রাখে। ভোরের দিকে জঙ্গিরা তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রান্না করিয়েছিল।

শিশির সরকার বলেন, ‘ওই ঘটনার পর যে বেঁচে আছি—এ জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। আর যেন কখনও এ রকম ঘটনার কেউ মুখোমুখি না হয়। ওই ঘটনা সবসময় ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু তারপরও দুঃসহ সেই স্মৃতি মাঝে মধ্যে ফিরে আসে। মনে পড়লেই গা শিউরে ওঠে।’