পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে, কিংবা উদ্ধারে নানামুখী তৎপরতা চালাতে চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু যেসব দেশে অর্থপাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়, সেসব দেশের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগের কোনও সক্ষমতা নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চিঠি দিয়ে সহযোগিতা চাইতে হয়। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতাসহ নানামুখী সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের।
পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারে যা করতে পারে দুদক
‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪’ এবং ‘মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’-এর বিধান অনুযায়ী, ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাত্র একটির। ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’ লব্ধ অর্থের মানিলন্ডারিং তদন্তের জন্যই কেবল তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত। অথচ বিভিন্ন গবেষণা বা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছে— বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। অথচ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচারের অনুসন্ধান কিংবা তদন্তের দায়িত্ব দুদকের নেই। এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। তবে এ দুটি সংস্থা পাচার ঠেকানো কিংবা পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে পেরেছে, এমন তথ্য কারও জানা নেই। দুদক কেবল ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার হলে তা তদন্ত করে থাকে।
আরও যা করতে চায় দুদক
দুদকের দায়িত্বশীলরা বলছেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে গ্লোব নেটওয়ার্কের সদস্য হতে চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সে লক্ষ্যে এরইমধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু করেছে তারা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দিয়ে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি জাতিসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোব নেটওয়ার্কের মেম্বার হওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এই নেটওয়ার্কে ৭২টি দেশের ১৩২টি সংস্থা এরইমধ্যে সদস্য হিসেবে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই তালিকায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনও সংস্থা সদস্য হতে পারেনি। গ্লোব নেটওয়ার্কের সদস্য হতে হলে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যে কারণে দুদক থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদের সচিব বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। কী কী কারণে এ সংস্থার সদস্য হওয়া প্রয়োজন সেটাও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে পাঠানো এ চিঠির এখনও কোনও অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে দেওয়া দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ২০২১ সালের জুনে ইউনাইটেড ন্যাশনস্ অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) আওতায় প্রতিষ্ঠিত ‘গ্লোব নেটওয়ার্ক’ নামে একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। আয় দুর্নীতি, মানিলন্ডারিং, অর্থপাচারের অনুসন্ধান, তদন্ত এবং পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে সদস্য দেশগুলোর অ্যান্টি করাপশান ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি টু এজেন্সি ভিত্তিক সহযোগিতা আদান-প্রদান, ইন্টেলিজেন্স এক্সচেঞ্জ এবং ইনফরমেশন শেয়ারিংয়ের লক্ষ্যে এই আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউএনসিএসি’র (ইউএন কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশান) সদস্য রাষ্ট্রের অ্যান্টি করাপশান এজেন্সিগুলোর জন্য এ নেটওয়ার্কের সদস্যপদ উন্মুক্ত করা হয়েছে। তাই জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে এবং ইউএনসিএসি’র অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারে।
সদস্য হওয়ার সুবিধাগুলোর বিষয়ে দুদকের চিঠিতে বলা হয়, গ্লোব নেটওয়ার্কের সদস্য হতে কোনও আবেদন ফি বা আবশ্যিক কন্ট্রিবিউশন ফিও নেই। এ নেটওয়ার্কে যুক্ত হলে দুর্নীতি এবং দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট অর্থপাচার, মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তদন্ত সংশ্লেষে এ নেটওয়ার্কের সদস্য দেশগুলো থেকে ইনফরমেশন বা ইন্টেলিজেন্স প্রাপ্তি এবং পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়া সহজ হবে। যে কারণে বর্তমানে বিশ্বের ৭২টি দেশের ১৩২টি সংস্থা এই গ্লোব নেটওয়ার্কের সদস্যপদ গ্রহণ করেছে।
তথ্য পেতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি
দুদকের কাছে থাকা যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্স ডিফেন্স স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। যে কারণে তারা সেখানে গোল্ডেন ভিসা পেয়েছেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে ৯৭২টি প্রপার্টি কেনার তথ্য মিলেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদকের মানিলন্ডারিং ইউনিট। সম্প্রতি দুদকের উপ-পরিচালক রামপ্রসাদ মণ্ডল এসব তথ্য পেতে সহযোগিতা চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছেন। আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশের কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের পরিচয় জানতে চেয়ে দেওয়া দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী যেসব নাগরিক সংযুক্ত আরব আমিরাতে গোল্ডেন ভিসা পেয়েছেন, তাদের নাম ঠিকানা ও পাসপোর্ট নম্বরসহ কেনা সম্পদের তথ্য প্রয়োজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাতে তাদের তালিকা সংগ্রহ করে দেয়। কিন্তু সেই চিঠিরও কোনও অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে কিছু সীমাবদ্ধতা ও আইনি জটিলতা রয়েছে। তারপরও দুদক পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সহযোগিতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।’
দুদকের সদ্য বিদায়ী কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দুতাবাসের সহায়তায় যদি পাচারকারীদের তালিকা সংগ্রহ করে দুদককে সরবরাহ করে, তাহলে সেই তালিকার ভিত্তিতে দুদকের অনুসন্ধান টিম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন- দুবাইয়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে যারা গোল্ডেন ভিসা পেয়েছেন, তাদের তালিকা চেয়েও দুদক থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ কারণ, দুবাইয়ে বৈধ উপায়ে বিনিয়োগের কোনও সুযোগ নেই। যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা পাচারের মাধ্যমেই করেছেন বলে মনে করেন তিনি।
যা বললেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক
গত ১৭ জুলাই টিআইবির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’ অনুযায়ী— যে ২৭ ধরনের অপরাধ-সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা দুদকের ছিল, সেগুলো আবারও দুদকের এখতিয়ারভুক্ত করতে হবে। এ জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী, দুদকের ২৭ ধরনের অপরাধ তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা ছিল। পরে ২০১৫ সালে তা সংশোধন করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯ করা হয়। সেখানে তফসিলে শুধু ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’ বাদে অন্য ২৬টি অপরাধ-সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিং অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব দুদকের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’’
তিনি বলেন, ‘সংশোধনের মধ্য দিয়ে দুদকের ক্ষমতা কমানোর পাশাপাশি অপরাধীদের সুরক্ষা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।’ বিধি সংশোধন করে দুদকের ক্ষমতা পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে উদ্দেশ্যে দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা একাধিক আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে হ্রাস করা হয়েছে।’ এর অন্যতম উদাহরণ হিসেবে তিনি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালাকে উল্লেখ করেন।
দুদক সচিবের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক
রবিবার (৬ আগস্ট) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে ঢাকায় সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিষয়ের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলটি অর্থপাচার সংক্রান্ত আইনসহ দুদকের বিভিন্ন আইন নিয়ে আলোচনা করে দুদক সচিবের সঙ্গে। তারা জানতে চেয়েছে, বাংলাদেশ থেকে কীভাবে, কোন কৌশলে অর্থপাচার (মানি লন্ডারিং) হয়। দুর্নীতি দমনের বিদ্যমান কৌশলের পাশাপাশি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে কী কী নতুন কৌশল নেওয়া যায়, তা নিয়েও আলোচনা করেছে তারা।
আগামীকাল বুধবার পড়ুন:
দুদকের ভেতর-বাহির পর্ব ৩: জনস্বার্থবিরোধী কাজ ঠেকাতে যা করে দুদক
আরও পড়ুন: