সাগরে বছরে প্রাণ হারান ১৩৫০ জেলে, নিরাপত্তায় যত উদ্যোগ

বিরূপ আবহাওয়া ও জলদস্যুতাসহ নানা কারণে দেশের উপকূল ও সামুদ্রিক জলসীমায় প্রতি বছর গড়ে ১৩৫০ জেলে মারা যান। আবার কেউবা বৈরী আবহাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশের কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়ে কারাভোগসহ নানা ভোগান্তির শিকার হন। যে কারণে উপকূলীয় জলসীমায় থাকা ফিশিং বোট ও ট্রলারের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ভেসেল মনিটরিং ও ট্র্যাকিং সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসতে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জলসীমায় বিপুল সংখ্যক বাণিজ্যিক জাহাজ বা ফিশিং ট্রলার, যান্ত্রিক ও কাঠের তৈরি ইঞ্জিনচালিত নৌকা মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকে। মাছ ধরতে গিয়ে সাগরের বিরূপ আবহাওয়ার কবলে পড়ে  বা জলদস্যুতার শিকার হয়ে প্রাণ হারান অসংখ্য জেলে। কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, এভাবে প্রতি বছর গড়ে এক হাজার ৩৫০ জন জেলে মারা যান। অনেক ক্ষেত্রে তারও বেশি জেলে মারা যান বলে জানা গেছে। আবার মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত অনেক জলযান ভুলবশত আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে। ফলে সেসব দেশের কোস্ট গার্ডের হাতে আটক  হয়ে দীর্ঘ দিন কারাভোগসহ নানা ভোগান্তির শিকার হন। যে কারণে দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জলসীমায় মাছ ধরায় নিয়োজিত সব জলযানের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স প্রদানের সময় জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ও ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) সেটসহ নিরাপত্তা ও নেভিগেশনাল ইকুইপমেন্ট নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে করে ভেসেল মনিটরিং সিস্টেম ও ট্র্যাকিংয়ের আওতায় এনে ফিশিং বোট ও ট্রলারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত  নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সমুদ্রগামী বাংলাদেশি ফিশিং বোট ও ট্রলারগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রম সংক্রান্ত অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে, দেশের উপকূলীয় ও সমুদ্রসীমায় এখতিয়ারভুক্ত সব সমুদ্রগামী বাংলাদেশি ফিশিং বোট, ট্রলার ট্র্যাকিং ও মনিটরিং করার জন্য বোট ও ট্রলারের রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স দেওয়ার সময় জিপিএস, এইচএফ, ভিএইচএফ, এআইএস (অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম), জিএসএম (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন) সেট থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। 

কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময় উপকূলীয় বা সমুদ্রগামী বাংলাদেশি ফিশিং বোট ও ট্রলার বিরূপ আবহাওয়ায় পড়ে হারিয়ে যায়। অনেক সময় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা পার হয়ে ভুলক্রমে প্রতিবেশী দেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে। যে কারণে সমুদ্রে দস্যুতাসহ অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৫ সালে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা হয়। সমুদ্রগামী বাংলাদেশি ফিশিং বোট ও ট্রলারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বোটগুলোর নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর কেবিন টপে লেখা প্রয়োজন। তাহলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনীর মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট বা হেলিকপ্টার দিয়ে এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জন্য মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট বা হেলিকপ্টার কেনা হলে, ফিশিং বোটগুলো দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন দুর্ঘটনা কবলিত বোটগুলো তাৎক্ষণিক খুঁজে বের করে উদ্ধার করা সহজ হবে। এছাড়া দুর্যোগে পতিত বোটগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে শনাক্তকরণ এবং উদ্ধারের লক্ষ্যে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো ডিজাস্টার এলার্ট ট্রান্সমিটার (ডিএটি) স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকেও সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলো ট্র্যাকিং বা মনিটরিং করার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সেই প্রকল্পের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের সমন্বয় করা গেলে আরও কার্যকরভাবে সমুদ্রে মাছ ধরা জলযানকে মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে সহজ হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্যিক, যান্ত্রিক ও আর্টিশনাল ফিশিং ভেসেল মনিটরিং ও ট্যাকিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে এবং জেলেদের নিরাপত্তায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্ট (এসসিএমএফপি)’ নামে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৯ সাল থেকে এ প্রকেল্পর মাধ্যমে কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মনিটরিং, কন্ট্রোল, সার্ভিল্যান্স (এমসিএস) ব্যবস্থা জোরদারে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ব্র্যান্ডউইথ ব্যবহার করে ইতোমধ্যেই চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় একটি ফিশিং ভেসেল মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতিনিধিত্বে জয়েন্ট মনিটরিং সেন্টার (জেএমসি) স্থাপন করা হয়েছে চট্টগ্রামে।

এ প্রজেক্টের উপ প্রকল্প পরিচালক মনিষ কুমার মণ্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভেসেল মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় তিন ধরনের নৌযান রয়েছে। কোনও নৌযানকেই ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া সমুদ্রে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয় না। মনিটরিংয়ের জন্য ছোট বোটগুলোতে ইতোমধ্যে আট হাজার ৪০০ ডিভাইস লাগানো হয়েছে। তবে পুরো সিস্টেমটা এখনও সম্পন্ন হয়নি। সফটওয়্যারের কিছু কাজ বাকি আছে। তবে আমরা এখন বোটগুলোকে দেখতে পারি। মোবাইল নেটওয়ার্ক ভিত্তিক জিএসএম-এর মাধ্যমে মনিটরিংয়ের বিষয়টি সম্পন্ন হয়েছে। এর মাধ্যমে সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দুরত্বের নৌযানও মনিটরিং করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘তবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যে মনিটরিংয়ের কাজ করা হবে, সেটা এখনও শেষ করা যায়নি। সেটা শেষ হলে উপকূল থেকে ১৫০ কিলোমিটার দুরে অবস্থানরত জলযানগুলোকে এআইএস বা অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমের মাধ্যমে মনিটরিং করা সম্ভব হবে।’