X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়িবাঁধ সংস্কারে বন উজাড়, ঝুঁকিতে উপকূল

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০আপডেট : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০

ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে সমুদ্র উপকূলকে রক্ষায় পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলছে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ। প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা, কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। বাঁধ নির্মাণে ধ্বংস করা হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। শুধু তাই নয়, সংস্কার কাজের মান নিয়েও উঠেছে নানান প্রশ্ন। স্থানীয়দের অভিযোগ, বাঁধে ব্যবহার করা হয়েছে সংরক্ষিত বনের বালু মিশ্রিত মাটি। উজাড় করা হয়েছে প্রায় শত একর বনভূমি। বনের জমিতে দিঘি কেটে বানানো হয়েছে মাছের ঘের। বন ধ্বংস বন্ধে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলেও কোনও সুফল আসেনি। উল্টো প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে মামলা।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ৪৮নং পোল্ডারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ উন্নয়নের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই। উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প, ফেজ-১ প্রকল্পের আওতায়, প্যাকেজ-২ এর কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা রয়েছে। শুরুতে এ কাজ চিনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআইসিও (সিকো) শুরু করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি। 

এরপর স্থানীয় বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সাব ঠিকাদার নিয়োগ করে সিকো। তারপরই শুরু হয় নানা অনিয়ম, ওঠে বিস্তর অভিযোগ। স্থানীয়রা বলছেন, উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ নির্মাণে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা মাটির পরিবর্তে বালু ব্যবহার করেছে। এমনকি বালু মিশ্রিত মাটি আনা হয়েছে সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে। যার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের জানমাল রক্ষাকবচ সংরক্ষিত বনাঞ্চল।

সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে এমন অসংখ্য পুকুর (ছবি: প্রতিবেদক)

বিশালাকৃতির হাজার হাজার গাছ কেটে বন থেকে মাটি তোলায় সেইস্থানে তৈরি করা হয়েছে বড় বড় দিঘি। আর বনের মালিকানা দাবিতে এসব দিঘিতে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে সমুদ্রবেষ্টিত উপকূলের সবুজ বেষ্টনী দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ভেস্তে গেছে সরকারের মূল পরিকল্পনা। এসব অনিয়মে জড়িত রয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও বনবিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা, এমন দাবি ভুক্তভোগীদের। বেড়িবাঁধের পাশের বসবাসকারীদের অভিযোগের শেষ নেই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য দুলাল সিকদার বলেন, বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে যে মাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা বালু মিশ্রিত। গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনের গাছ ভেকু দিয়ে উপড়ে ফেলে মাটি আনা হয়েছে। বন উজাড় করে মাটি এনে ব্যবহার করা হয়েছে বেড়িবাঁধে। এ বিষয় তারা বিভিন্ন সময় বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনকে অবহিত করলেও তারা দেখছি, দেখবো বলে আশ্বস্ত করলেও কোনও সুফল পাওয়া যায়নি। তার অভিযোগ বন উজাড় করার পেছনে বন বিভাগের কর্মকর্তারাই দায়ী।

বনের উপকারভোগী মো. হেমায়েত ফকির বলেন, বাঁধ সংস্কার করতে গিয়ে শত শত একর বনভূমি উজাড় করা হয়েছে। বন বিভাগ শুধু কয়েকটি মামলা করেই তাদের দায়িত্ববোধ শেষ করেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী সাব ঠিকাদাররা বন ধ্বংস করে মাটি এনে বেড়িবাঁধে ব্যবহার করেছে। হাজার কোটি টাকার বনভূমি উজাড় করা হয়েছে দাবি তার। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলে উল্টো তাদের নামে মামলা করা হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে প্রাণনাশের।

সংস্কার করা হচ্ছে বাঁধ (ছবি: প্রতিবেদক)

কুয়াকাটা পৌরসভার প্যানেল মেয়র (২) শহিদ দেওয়ান বলেন, সাব ঠিকাদাররা বেড়িবাঁধে সংস্কারে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। মাটির চেয়ে বালুর ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। রাতের আঁধারে বাঁধের ঢাল থেকে বালু উঠিয়ে বাঁধের মধ্যে দিয়ে উপরে শুধু মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং পৌর মেয়রের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলীর হস্তক্ষেপে আবার কাজ শুরু করা হয়েছে।

এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বন উজাড় করার কারণে ঝড় বন্যার সময় ঝুঁকি বেড়েছে। মাটির পরিবর্তে বাঁধে বেশিরভাগই বালু ব্যবহার করায় বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে তাদের শঙ্কা রয়েছে।

বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, জনবল সংকটের মধ্যেও তারা বন রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক সহযোগিতা না পাওয়ায় বন রক্ষায় তারা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেননি। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর পর তারা কয়েক দফা পরিদর্শন করেছেন।

পাউবো কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে বেশ কিছু অভিযোগ ছিল। সেগুলো সমাধান করেই কাজ চলমান রয়েছে। তবে বাঁধে ২৫ ভাগ বালু ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। 

বাঁধে বনের মাটি ব্যবহারের বিষয় তিনি জানান, বাঁধে মাটি কিনে ব্যবহার করা হয়েছে। সাব ঠিকাদাররা কোথা থেকে মাটি এনেছেন, এটা তাদের জানার কথা নয় বলেও জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাটা হয়েছে গাছ, যার সাক্ষী হিসেবে এখনও দাঁড়িয়ে আছে গুঁড়িগুলো (ছবি: প্রতিবেদক)

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন রক্ষার জন্য বনবিভাগকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। তার কাছে এমন অভিযোগ এলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে কয়েকটি ড্যাম্প ট্রাক ও ভেকু জব্দ করা হয়েছে। বনের মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছে। 

তবে বনের জমির মালিকানার প্রশ্নে তিনি জানান, ‘কীভাবে তারা বনের জমির মালিক হয়েছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

তবে সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা মামলাসহ নানামুখী উদ্যোগের কথা বললেও ইতিমধ্যে কুয়াকাটার গঙ্গামতি সংরক্ষিত বন, লেম্বুর বনসহ উপকূলের কয়েক শত বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। বনপ্রেমীদের মতে, এই প্রকল্প সংস্কার করতে গিয়ে হাজার কোটি টাকার বন ধ্বংস করা হয়েছে। এর দায় কে নেবে, এমন প্রশ্ন উপকারভোগীদের। উপকূলের রক্ষাকবচ খ্যাত সংরক্ষিত বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

/ইউএস/
সম্পর্কিত
ঈদে পর্যটক বরণে প্রস্তুত কক্সবাজার
‘বন কর্মকর্তার হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে কাজ করছে মন্ত্রণালয়’
বিশুদ্ধ পানির প্রকল্পে এখন গোয়ালঘর
সর্বশেষ খবর
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
দায়িত্ব পালনকালে কতটা সুরক্ষা পাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস আজদায়িত্ব পালনকালে কতটা সুরক্ষা পাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা
শাহীনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের সিরিজ ভাগাভাগি
শাহীনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের সিরিজ ভাগাভাগি
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু