একটু ঝুম বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তা ভেসে যায় পানিতে। সেই পানি নামে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেটাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ফ্লাইওভারের ওপরেও পানি জমে থাকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত। পানি নিষ্কাষণের জায়গায় পলিথিন আটকে থাকাকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। চারপাশে চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে শ্যাম্পু, সাবান, সস— কোনোটাতে নেই পলিথিন। প্রশ্ন হলো, এত পলিথিন ফেলে কে?
দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ লাখ ৬০ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থেকে। এর মধ্যে এক লাখ ৯২ হাজার ১০৪ টনই বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর মিনিপ্যাক বলে গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ‘প্লাস্টিক স্যাশে: স্মল প্যাকেট উইথ হিউজ এনভায়রনমেন্ট ডেস্ট্রাকশন’ শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এসডোর গবেষণা তথ্য বলছে, কেবল খাবারের (চিপস, টমেটো সস, জুস, গুঁড়ো দুধ, কফি ইত্যাদি) মিনিপ্যাকেই ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্র প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। ক্ষুদ্র প্লাস্টিক বর্জ্য ক্রমে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্লাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। শহরে জলাবদ্ধতা থেকে শুরু করে নদীদূষণেও প্লাস্টিক বড় ভূমিকা রাখছে।
এসডোর সমীক্ষা বলছে, ১৫-১৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে স্যাশে পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। তারা বেশিরভাগই ব্যক্তিগত যত্নের আইটেম যেমন-শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, সস, কফির মতো খাদ্য প্যাকেজিং ব্যবহার করে থাকে। ব্যবহারের ডাটা সেই অনুযায়ী গণনা করা হয়েছিল। সারা দেশে ৫ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা দৈনিক আনুমানিক ১২৯ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে।
বিষে বিষ ক্ষয় হবে কী?
প্রবাদ বাক্য আছে বিষে বিষ ক্ষয়। এবার প্লাস্টিকের হাত থেকে বাঁচার এই প্রাথমিক পদ্ধতির কথাই বলছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, যারা এই বিশাল প্লাস্টিকের ব্যবহারকারী, তাদের সঙ্গে নিয়েই এই দুর্যোগ থেকে রক্ষার পথ বের করতে হবে। এসডোর সমীক্ষা আরও বলা হয়, ১৫-১৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে স্যাশে পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। সেই বয়সটাকে মাথায় রেখে তারা রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকা থেকে মোহাম্মদপুরের টাউন হল, আসাদ গেট, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা এবং ধানমন্ডি ২৭ হয়ে লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দিয়ে বর্জ্য কুড়িয়ে রাস্তা পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে এই বার্তা দিতে চায় যে, যারা রাস্তায় এসব ফেলছে, তাদেরই পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিতে হবে। মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী একদিনে হেটে ৮৯ কেজি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য কুড়িয়েছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনা মহামারিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ওয়ানটাইম ও মিনিপ্যাক প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সর্বত্র এটি বেড়ে ওঠার তথ্য মিলছে। ওইসব দেশে সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও এসব বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেলিন চৌধুরী মনে করেন, পলিথিন কুড়ানোর চেয়ে কীভাবে এর উৎপাদন বন্ধ করা যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। তারপর যারা ব্যবহার করে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে বলেন, ‘এই পলিথিন প্লাস্টিক প্রডাক্ট মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর— তা আমরা কল্পনা করতে পারি না বলেই এর ব্যবহার থামে না।’
লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এটা এখন স্বীকৃত যে, যেসব উপাদান ক্যানসার তৈরি করে, প্লাস্টিক তার মধ্যে অন্যতম। আবার খাবার ও বাতাসের সঙ্গে পলিথিন শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুসের ক্ষতি হয়। রক্তনালীর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে লিভার নষ্ট করে। পাকস্থলীতে গেলে আমাদের হজমে সমস্যা তৈরি হয়। এমনকি বন্ধ্যাত্বেরও বড় কারণ হিসেবে পলিথিন কাজ করে। এই যে পরিবেশের দূষণ— এটা জীবনীশক্তিকে শেষ করে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সভ্য জাতিকে দুটো কাজ করতে হয়। কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায় আইন দিয়ে সুনির্দিষ্ট করতে হয়। যারা আইন ভাঙে তাদের আইনের আওতায় আনতে হয়। যে পলিথিন নিষিদ্ধ তা বাজারে কীভাবে আসে, আর আমরা কীভাবে ব্যবহার করি, সেটা একইসঙ্গে দেখতে হবে।’
অধিদফতরের বিভিন্ন উদ্যোগ
পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।
কেন তারপরও পলিথিন বন্ধ হচ্ছে না— প্রশ্নে পরিবেশ অধিকারকর্মীরা বলছেন, একদিকে যততত্র পলিথিন তৈরি ও বাজারজাত হচ্ছে, আরেকদিকে মানুষ অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে না। পলিথিন সস্তা এবং ব্যবহার উপযোগী বলে ব্যবহার করছে এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো যত্রতত্র ফেলছে। একবার ভাবছেনও না— এই পলিথিন কীভাবে বিপদ ঘটাচ্ছে। বাজারে এখন যে বিকল্পগুলো আছে সেগুলো ব্যাপকহারে ছড়ানো বা জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়নি।
পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক (বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনা) ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কম জনবলেও আমরা গত পাঁচ বছরে সাড়ে তিন হাজারের বেশি অভিযান চালিয়েছি। আমরা প্রথমবারের মতো একটা মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যেখানে পলিথিনের উৎপাদক, ভোক্তা, আইন প্রয়োগকারী সবাই মিলে একটা জায়গায় কাজ করার প্ল্যাটফর্ম তৈরি হবে। এটা বন্ধে কার কী দায়িত্ব— তা চিহ্নিত করে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কাজ করছি।’