শেল ব্যাংকিং: ঠেকানো যাচ্ছে না অর্থপাচার

নানা উপায়ে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে অর্থ। প্রতি বছর পাচার হওয়া অর্থের হদিসও পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। আমদানি-রফতনির আড়ালে শেল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারে সক্রিয় রয়েছে পাচারকারীরা। টাকা পাচারের নতুন এ রুট বন্ধ করতে হিমশিম খাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) অন্যান্য সংস্থা। কয়েক বছর আগেই এই শেল ব্যাংকিংয়ের সন্ধান পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। শেল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের সন্ধানে বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করে সেই টাকা ফেরত আনার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন দুদকের মানিলন্ডারিং শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, শেল ব্যাংকিং মানিলন্ডারিং বা অর্থপাচারের ক্ষেত্রে নতুন আপদ। অস্তিত্বহীন এই ব্যাংকিং চ্যানেলে  টাকা পাচার হলে তার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়া খুব কঠিন। শুধু এটুকু বুঝতে পারা যায় যে, কোনও কোম্পানি পণ্য রফতানি করেছে। কিন্তু সেই টাকা আর দেশে ফেরত আসেনি। এতে বুঝা যায়, এটা পাচার হয়ে গেছে। পাচারের উদ্দেশ্যেই এমনটি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউ’র তদন্তেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। যে কারণে ২০২০ সালের ১৬ জুন এ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন সংক্রান্তে ঝুঁকি প্রতিরোধে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়— শেল ব্যাংকের সঙ্গে কোনও ধরনের ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। শেল ব্যাংক বলতে ওইসব ব্যাংককে বুঝাবে— যার যেই দেশে নিবন্ধিত বা লাইসেন্স প্রাপ্ত। সেই দেশে কোনও বাহ্যিক বা বাস্তবে উপস্থিতি নেই। যেটি কার্যকর পরিদর্শনের আওতাভুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত কোনও আর্থিক গ্রুপেরও সদস্য নয়। করেসপনডেন্ট ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও শেল ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করার কথা বলা হয়েছে। দেশের প্রতিটি ব্যাংককে নিশ্চিত হতে হবে যে, রেসপন্ডেন্ট ব্যাংক কোনও শেল ব্যাংককে সেবা দিচ্ছে না, বা সম্পর্ক রাখছে না। বিএফআইইউ বিষয়টি নিয়মিত তদারকি করবে।  

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ২০১৯ সালের শেষ দিকে বিএফআইইউ’র তদন্তে শেল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচারের বিষয়টি ধরা পড়ে। দেশে এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম নিষিদ্ধ। এরপরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে পণ্য রফতানিতে সহায়তা করায় তফসিলি ব্যাংকগুলোকে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে এই নির্দেশনা মেনে চলতে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুদক কর্মকর্তারা জানান, শেল ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমদানি-রফতানির আড়ালে কারা এসব টাকা পাচার করছে, তাদের তালিকা করা হচ্ছে।

এদিকে মধ্যপ্রচ্যের দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ। কারা এসব বিনিয়োগ করছে— তা জানতে প্রায় তিন মাস আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চিঠিতে বিনিয়োগকারীর বিস্তারিত পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে। দুদকের মানিলন্ডারিং ইউনিট নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দুবাইয়ে কয়েকজন বিনিয়োগকারীর তথ্য পেয়েছে, যারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মালিকানাধীন এক হাজার ৪৪টি কোম্পানি দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ নিয়েছে। সব মিলিয়ে দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ পাওয়া বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানি প্রায় ১০ হাজার ৯৭৫টি বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। এদের মধ্যে গোল্ডেন ভিসা রয়েছে ৪৫৯ জনের।

দুদক অনুসন্ধানে নেমে চলতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাংলাদেশ দুতাবাসে চিঠি পাঠিয়েছে। বাংলাদেশিদের নাম, ঠিকানা ও পাসপোর্ট নম্বরসহ ক্রয় করা সম্পদের তথ্য জানতে চাওয়া হয় এসব চিঠিতে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রণালয় থেকে বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে এখনও কোনও তথ্য পায়নি দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে কোনও ফিরতি তথ্য দেওয়া হয়নি দুদককে।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে দুদক কী করছে, সেটা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ওইদিন দুপুরে দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ-এর চার সদস্যের প্রতিনিধি দল।

দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর জন্য বিভিন্ন দেশের যে সেন্ট্রাল অথরিটি থাকে, তাদের মাধ্যমে তারা এমএলএআর (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্ট রিকোয়েস্ট) পাঠিয়েছে। তবে তাদের কাছ থেকে তথ্য বা জবাব পেতে অনেক ক্ষেত্রেই বিলম্ব হয়। কারণ, এটা শুধু বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করে না। যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সে দেশের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অর্থপাচার প্রতিরোধে দুদক সক্রিয়ভাবেই কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।