ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বাইরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় অভিযুক্ত কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর পরই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে বক্তব্য প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (জননিরাপত্তা বিভাগ), পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ডিএমপি কমিশনার, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, (সি.আই.ডি), গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর মহাপরিচালককে (ডিজি) এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) ১০ আইনজীবীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুবুর রহমান খান এই নোটিশ প্রেরণ করেন। আইনজীবীরা হলেন–অ্যাডভোকেট রাসেল আহম্মেদ, অ্যাডভোকেট আবদুল্যাহ আল মাহমুদ, অ্যাডভোকেট আল-ফয়সাল সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট মো. মহসিন কবির, অ্যাডভোকেট মো. নজরুল ইসলাম ছোটন, অ্যাডভোকেট মো. শফিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট সামছুন নূর বাঁধন, অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার মাহমুদ, অ্যাডভোকেট মো. নুরুল হুদা ও অ্যাডভোকেট রাশেদুল হক।
নোটিশে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অভিযুক্তের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করার এখতিয়ার একমাত্র বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় অভিযুক্ত কোনও ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার করা উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থি এবং আদালত অবমাননার শামিল। লিগ্যাল নোটিশকারীরা সুপ্রিম কোর্টের নিয়মিত আইনজীবী এবং সমাজের সচেতন নাগরিক এবং আইনের শাসন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত এবং সংবিধান সমুন্নত রক্ষার জন্য সর্বদা উচ্চকণ্ঠ।
নোটিশে বলা হয়, অতি সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিবর্গকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে বক্তব্য প্রচার করানো হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এরূপ কার্যক্রম শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই নয় বরং আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং অবৈধ।
এতে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার বিধানমতে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করার এখতিয়ার রয়েছে একমাত্র বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের। এছাড়া মামলার তদন্তের প্রয়োজনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতের আদেশ অনুযায়ী রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে রিমান্ড প্রতিবেদন দাখিল করার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার রয়েছে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদেরকে দিয়ে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রচারের সুযোগ নেই।
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত কোনও ব্যক্তি পুলিশ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালীন গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে বক্তব্য প্রচার না করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা রয়েছে। আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি বনাম রাষ্ট্র মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের রেফারেন্স দিয়েছেন।
কোর্টের রেফারেন্স দিয়ে লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়েছে, ফৌজদারি বিবিধ মামলা নং- ৪৭২৫৩/২০১৯ - এ প্রচারিত রায়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ‘এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা খুবই সঙ্গত হবে যে, ইদানিং প্রায়শ: লক্ষ করা যায় যে, বিভিন্ন আলোচিত অপরাধের তদন্ত চলাকালীন সময়ে পুলিশ-র্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করার পূর্বেই বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়, যা অনেক সময় মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অমর্যাদাকর এবং অঅনুমোদনযোগ্য; এবং বিভিন্ন মামলার তদন্ত সম্পর্কে অতি উৎসাহ নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে ব্রিফিং করা হয়ে থাকে।’
নোটিশে বলা হয়, আমাদের সকলকে স্মরণ রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে একজন অভিযুক্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না যে তিনি প্রকৃত অপরাধী বা তার দ্বারাই অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে। গণমাধ্যমের সামনে গ্রেফতারকৃত কোনও ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা সঙ্গত নয় যে, তার মর্যাদা ও সম্মান হানি হয় এবং তদন্ত চলাকালে অর্থাৎ পুলিশ রিপোর্ট দাখিলের পূর্বে গণমাধ্যমে গ্রেফতারকৃত কোনও ব্যক্তি বা মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে এমন কোনও বক্তব্য উপস্থাপন সমীচিন নয়, যা তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে বিতর্ক বা প্রশ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
নোটিশে বলা হয়, আমাদের আরও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মামলার তদন্ত এবং বিচার পর্যায়ে একজন অভিযুক্তের প্রাপ্ত আইনি অধিকার নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট সকলের দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সুতরাং, পুলিশ-র্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার করা আদালতের উপরোক্ত রায়ের পরিপন্থি এবং আদালত অবমাননার শামিল।
উপরোক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, অত্র নোটিশ প্রাপ্তির পর কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে উক্ত ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যথায় নোটিশ প্রেরণকারীগণ হাইকোর্ট বিভাগে আদালত অবমাননার দরখাস্ত দাখিলসহ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন বলেও নোটিশে জানানো হয়েছে।