১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন সাংবাদিকরা। অবরুদ্ধ দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুটের নিচে স্বদেশীদের মুক্তির আকুতি পত্রিকায় তুলে ধরেছিলেন তারা। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে মহান সাংবাদিকদের প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান করতে হবে। লড়াইয়ের সঠিক ইতিহাস লিখতে হবে।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাব আয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধ: ইতিহাস চেতনা ও অদম্য বাংলাদেশের গল্প' বিষয়ক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনের সভাপত্বিতে আলোচক হিসেবে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, বর্তমান সভাপতি ওমর ফারুক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক আইয়ুব হোসেন ভূইয়া।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়ঙ্কর দৃশ্যের কথা তুলে ধরে মফিদুল হক বলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের অঙ্গনটাও স্মৃতিকাতর করে তোলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গোলা জাতীয় প্রেস ক্লাবের দোতলায় আঘাত করেছিল। তখন সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তখন তিনি আহত হয়েছিলেন। পরে চিকিৎসা নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
তিন শহীদ সাংবাদিককে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, শহীদ সাবের অল্প বয়সে সাহিত্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছিলেন। সে সময়ে তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন। প্রেস ক্লাব ও পত্রিকার সঙ্গে আত্মিক বন্ধন কখনও তিনি ছিন্ন হতে দেননি। সারাদিন প্রেস ক্লাবে কাটাতেন। চার আনা পয়সা দিয়ে জীবন চালাতেন। প্রেস ক্লাব ছিল তার আশ্রয়, সংবাদ (দৈনিক পত্রিকা) ছিল রাতের ঘুমের স্থান। ২৫ মার্চ যখন সংবাদের অফিস দগ্ধ হয়, সেখানে তিনি পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছেন।
মফিদুল হক আরও বলেন, বামপন্থি আদর্শে বিশ্বাসী শহীদুল্লাহ্ কায়সার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাবন্দি ছিলেন। আরেকজন শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেন। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার শিকার। অবরুদ্ধ সময়ে ইত্তেফাক পত্রিকার 'হাল' (দায়িত্ব পালন করা) ধরেছিলেন।
অবরুদ্ধ দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুটের নিচে তিনি স্বদেশী মুক্তির আকুতি ইত্তেফাক পত্রিকায় তুলে ধরেছিলেন। সাংবাদিক জগতে তিনি নজির স্থাপন করেছেন। এমন আরও আছেন তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া। বঙ্গবন্ধু যে জাতীয় জাগরণ তৈরি করেছেন, সেখানে সাংবাদিকদের ভূমিকা আমাদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে। তারা মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভুমিকা রেখেছেন।
ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই জন পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছেন। সাংবাদিকরা আপসহীন মনোভাব দেখিয়েছেন, তাই তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সাংবাদিকতায় তাদের (মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের) আদর্শ কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি?
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, সাংবাদিকতায় সবসময় নিরপেক্ষতা থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্পষ্টভাবে সাংবাদিকরা দেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ২৫ বছর ধরে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। তাই ১৪ ডিসেম্বর (বুদ্ধিজীবী দিবস) সাংবাদিক মেরে ফেলা হয়েছে। ভারতেরও কয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন। তাদের পরিবার এখনও অপেক্ষায়। সে সময় সাংবাদিকরা ছিলেন আপসহীন। এখন সাংবাদিকদের হত্যা করার দরকার নেই। চাইলে কিনে নেওয়া যায়।
সাইফুল আলম বলেন, গত ৫১ বছর ধরে এই দিবস পালন করছি। কিন্তু মূল ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। সামরিক, অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকার সুষম বণ্টন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করেছে। স্বাধীন গণমাধ্যমও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবুও সব প্রগতিশীল আন্দোলনে সাংবাদিকরা ভূমিকা পালন করেছেন। অনেক ইতিহাস লেখা হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস লিখতে হলে সময়ের প্রয়োজন। ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে পেরেছি? বিচার করেছি?’