গান কবিতা পথনাটকে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের দাবি

‘ইসরায়েলি আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধ করো, ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ স্লোগানে গান, কবিতা ও পথনাটকের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা দাবি করেছেন সর্বস্তরের জনগণ। শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) বিকালে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি, বাংলাদেশের আয়োজনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিলে এ দাবি করেন তারা।

এ সময় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদ ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চেয়ে মিছিল করেছেন তারা এবং অবিলম্বে ফিলিস্তিনের জনগণের মুক্তি-সংগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় ও স্বচ্ছ ভূমিকা নেওয়ার দাবিও জানান তারা।

সমাবেশের আগে পথনাটক, গান, কবিতা আবৃত্তিতে ফুটিয়ে তোলা হয় ইসরায়েলি সাম্রাজ্যবাদ ও ফিলিস্তিনের মানুষের দুর্দশার চিত্র। সমাবেশ ও মিছিলে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সমাজিক ও ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন স্তরের হাজারো লোক এতে অংশ নেন।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পরিবেশনা শেষে বাংলাদেশে অবস্থিত ফিলিস্তিন দূতাবাসের পাঠানো বিবৃতি পাঠ করেন চৌধুরী মোফাদ আহমেদ। পরে ঘোষণাপত্র বক্তব্য পাঠ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। পরে মূল বক্তব্য প্রদান করেন ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি, বাংলাদেশের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে মিছিল

বক্তব্য শেষে সমগ্র দেশ থেকে এই আসা গণ্যমান্য ব্যক্তিরাসহ মিছিল শুরু হয়। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে মিছিলে অংশ নেন প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক মানুষ। মিছিলটি শাহবাগ মোড় থেকে শুরু হয়ে এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্সল্যাব মোড়, নিউমার্কেট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়।

তার আগে সমাবেশে সাম্রাজ্যবাদ মদদপুষ্ট ইসরায়েলি আগ্রাসন, দখল, গণহত্যা এবং অব্যাহত জুলুমের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিরোধকে সমর্থন করে বাংলাদেশের সর্বজনের পক্ষ থেকে তিন দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।

দাবিগুলো হলো, ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদার ইসরায়েলি নারকীয় আগ্রাসন ও গণহত্যা অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েলি দখলদারত্ব ও নিয়ন্ত্রণের পরিপূর্ণ অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের উভয় অংশের মানুষের জানমাল, জীবনজীবিকা, নিরাপত্তা ও পরিপূর্ণ মানবাধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন চুক্তি, প্রস্তাব ও শর্ত/মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বরাবরই ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে আমাদের অঙ্গীকারাবদ্ধ সম্পর্ক। অথচ আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে বাংলাদেশ সরকার ইসরাইলের প্রতি নমনীয় ভাব নিয়ে পাসপোর্ট সংশোধন করেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের কাছ থেকে সরকার জননিপীড়নের প্রযুক্তি ক্রয় করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এর নিন্দা করি এবং অবিলম্বে ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় ও স্বচ্ছ ভূমিকা নেওয়ার দাবি জানাই।

সমাবেশে সংগঠনটির আহ্বায়ক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আজ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিরা গণহত্যা ও দখলদারত্ব চালাচ্ছে। এটা বলা হয়ে থাকে, এটি আধুনিক সময়ে সামরিক দখলদারত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ফিলিস্তিনে গণহত্যা যে চলছে ও এটাকে যে থামানো যাচ্ছে না, সে জন্য আমাদের দুঃখ আরও বেশি। ফিলিস্তিন এখন একটা কারাগারে পরিণত হয়েছে। কারাগারে হত্যার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষ জানে। সেই অভিজ্ঞতা আমাদের ইতিহাসেই আছে। আমরা জানি ইসরায়েলের পেছনে আছে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শক্তি। তারাই এই যুদ্ধ চালাচ্ছে। ইউক্রেনের সঙ্গে যেমন পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার যুদ্ধ, তেমনি ফিলিস্তিনের সঙ্গে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধ।

প্রতীকী লাশ নিয়ে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান

তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেন, ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামে যখন ইসরায়েলের দুটো বধ্বংস হয়, তখন বিশ্বেজুড়ে তার নিন্দা হয়। এই যে গণমাধ্যম ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো গণহত্যাকে অস্বীকার করে বলতে চায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এটা তো সংঘর্ষ নয়, এটা গণহত্যা, আর গণহত্যা কী আমরা জানি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম থেকে আসছে তাদের গড় আয়ু সাড়ে ৮২ বছর। আর সেখানকার আরবদের গড় আয়ু তিন-চার বছর কম। এই যে গড় আয়ুর পার্থক্য রয়েছে। সেটিই বলে দিচ্ছে, সেখানে কী রকম ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া ইসরায়েল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র। যখন ইথিওপিয়া থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিরা যায়, তারা সেখানে মর্যাদা পায় না। দুঃখের বিষয় হলো ইহুদিদের পূর্বপুরুষেরা হিটলারের যে বর্বরতা দেখেছে, সেটি আজ তারা ভুলে গেছে। সেই হলোকাস্ট এখন ফিলিস্তিনিদের ওপর চালাচ্ছে। আজ ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামটা আমাদের সংগ্রাম ও সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

সমাবেশে লিখিত বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ বলেন, চলতি বছরের ৭ অক্টোবর থেকে দখলদার ইসরায়েলের ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের নতুন পর্যায়টি নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ রূপে হাজির হয়েছে, যা আজ (২৯ ডিসেম্বর) ৮৪ দিন ধরে বিরামহীনভাবে অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী ২১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ৮ হাজারের বেশি শিশু এবং ৬ হাজারের বেশি নারী। অনুমান করা হচ্ছে আরও ৮ হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।

আন্তর্জাতিক কোনও আইনবিধি ইসরায়েল মান্য করছে না। প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল গাজাকে আন্তর্জাতিক আইনের কবরস্থানে পরিণত করেছে। ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণকে তারা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু ইসরায়েল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে হত্যা-জুলুম করে যাচ্ছে ১৯৪৮ থেকে, আর হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৭ সালে। এই দুই সময়ের মধ্যেই দখলদারদের হাতে প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি খুন হয়েছেন।