বেশি দরে গরুর মাংস বিক্রির নানা অজুহাত

নির্বাচনের পরেই নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে বাজারে। হুড়মুড় করে বাড়তে শুরু করেছে চাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবারও বেড়েছে গরুর মাংসের দাম।

সপ্তাহখানেক আগেও যেখানে গরুর মাংস প্রতিকেজি ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। পবিত্র মাহে রমজানের আগেই গরুর মাংসের এই বাড়তি দাম কেন, তার সদুত্তর দিতে পারেননি কোনও বিক্রেতা। তবে বাড়তি দামে গরুর মাংস বিক্রির নানা অজুহাত দিয়ে যাচ্ছেন তারা।

মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গরুর মাংসের মূল্য বৃদ্ধির নানা কারণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গরুর মাংস বিক্রির বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য জানা গেছে।

অনেক বিক্রেতার দাবি, কোনও সিন্ডিকেট নয়, গরু কেনার ওপরেই নির্ধারণ হয় মাংসের দাম। অনেকে বলছেন, গরুর মাংস বিক্রেতারা মিলেই এক দামে মাংস বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, কত টাকা দরে মাংস বিক্রি করা হবে, তা নির্ধারণ হয় পেছনের কারও দ্বারা। আর অন্য বিক্রেতাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে, সেই শঙ্কা আর লোভেই বেড়ে যায় গরুর মাংসের দাম।

বাজারে গরুর অভাব না থাকার পরও মাংসের দাম বেড়েছে কেন, জানতে চাইলে রায় সাহেব বাজারের মাংস বিক্রেতা মনোয়ার হোসেন মনা একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, দাম কেন বাড়লো, এ প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস না করে শেখ হাসিনাকে (প্রধানমন্ত্রী) জিজ্ঞেস করেন। ২০ থেকে ৩০ টাকা পেঁয়াজের দাম যখন ২০০ থেকে ২৫০ হইছে, সেখানে মানুষ কিছু বলে না। মানুষ শুধু মাংসের দাম নিয়ে কথা বলে। মাংস না খাইলেও তো চলে, কিন্তু দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া তো চলে কি?

গরুর মাংস বিক্রিতে নির্দিষ্ট দাম রাখা নিয়ে কোনও চাপ আছে কিনা বা কোনও সিন্ডিকেট সবাইকে একই দামে মাংস বিক্রি করতে বাধ্য করে কিনা, জবাবে তিনি বলেন, সেটা আমি মুখে বলতে পারবো না। কয়দিন আগে গরুর মাংস কম দামে বিক্রি করায় রাজশাহীতে এক দোকানদারকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের পরিবার আছে। আমরা নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না।

নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারের মাংসের দোকানদার জিয়া উদ্দিন বলেন, গরুর মাংসে দাম বাড়ছে। আগের চেয়ে গোখাদ্যের দাম বাড়ায় আমরা এক সপ্তাহ আগেও ৬৫০ টাকা বিক্রি করেছি। কিন্তু এখন গরু অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। তাই দাম বেড়েছে মাংসের।

‘আমাদের যদি গরু বেশি দামে কিনতে হয়, তাহলে দাম বাড়বে।’ রমজান মাসে গরুর মাংসের দাম আর বাড়ার আশঙ্কা আছে কিনা, এমন প্রশ্নে বলেন, যদি কম দামে কিনতে পারি তাহলে কেন বাড়াবো?

নাজিরাবাজারের মাংস বিক্রেতা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, গরু কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। আগে গরুর দাম কম ছিল, তাই কম দামে বিক্রি করেছি।

নির্বাচনের আগে তো ঠিক ছিল, পরেই কেন হুট করে মাংসের দাম বেড়েছে? উত্তরে বিক্রেতা বলেন, তখন চাপ ছিল কম দামে বিক্রি করার। লস দিয়ে হলেও আমরা বিক্রি করেছি। এখন আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়।

‘সেটা এখন বলতে পারি না। সবাই যদি বাড়ায় আমরাও বাড়াবো, কমে কেন বিক্রি করবো?’ রমজান উপলক্ষে মাংসের দাম আর বাড়বে কিনা, জানতে চাইলে তিনি এভাবে বলেন।

কলতাবাজার এলাকায় কলিজা, ফুসফুসসহ এক কেজি গরুর মাংস ৬০০ টাকা বিক্রি করা হয়। তবে এক কেজিতে কলিজা-ফুসফুস ও হাড়ের পরিমাণ থাকে প্রায় ৪৫০ গ্রাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৬০০ টাকায় গরুর মাংস করা বিক্রেতা বলেন, আমরা যে কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করি, এটা যখন পত্রপত্রিকায় যায়, তখন আমাদের ওপর চাপ আসে কেন কম দামে বিক্রি করলাম। এখন আমার কম দামে বিক্রি করলে পোষায়, লাভ হয়, এ জন্য করি। তবে শুধু মাংস ৬০০ টাকায় বিক্রি করা কখনও সম্ভব না।

তবে বেশি দামে গরুর মাংস বিক্রির ভিন্ন এক তথ্য দিলেন রায়সাহেব বাজারের এক কসাইয়ের সহযোগী আনিস মিয়া। তিনি বলেন, দাদা ভাই রাতে যা দাম বলে দিয়ে যায়, সেই দামেই গরুর মাংস বিক্রি হয়। ওনার কথার বাইরে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই।

কে এই ‘দাদা ভাই’, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওনাকে সবাই দাদা ভাই বলে সম্বোধন করেন। দিনের বেলায় ওনাকে দেখা যায় না, রাতে আসেন। এই বাজার থেকে যারা টাকা তোলেন, তাদের সঙ্গে দেখা করে ২০ থেকে ২৫ মিনিট থেকে আবার চলে যান।

এখানের এক মাংস বিক্রেতা বলেন, বাজার যেভাবে চলছে, আমাদেরও সেভাবে চলতে হবে। সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে বিপদে পড়তে হয়। আমি একা ভালো সাজতে গিয়ে বিপদে পড়তে পারি না। স্রোতের বিপরীতে না যাওয়াই ভালো। ব্যবসা যেহেতু করছি, তাল মেলাতে হবে। আর গরুর মাংস চাইলেই দাম কমিয়ে হাড় বেশি দিয়ে বিক্রি করা যায়।

আরও বলেন, আমরা যেটা ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করি, সেটা শুধু মাংস, হাড় নেই। হাড় সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম থাকে। এখন আমরা যদি এক কেজি মাংসে ২৫০ গ্রাম হাড় দিই, তার সঙ্গে কলিজা বা ফেফসা দিই, তাহলে ৬০০ বা ৬৫০ টাকা বিক্রি করলেও চলবে। এখন এই বাজারে সবাই বিক্রি করছে ৭০০ টাকা, আমি যদি একটু কম দামে বিক্রি করি, তাহলে বাকিদের রোষানলে পড়তে হবে।

হঠাৎ গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধিতে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন ক্রেতারা। রায় সাহেব বাজারে মাংস কিনতে আসা তানজিম হাসান বলেন, বাসায় মেহমান এসেছে, তাই গরুর মাংস কিনতে এসেছি। কিছু দিন আগে শুনেছি রায় সাহেব বাজারে মাংসের দাম ৬০০ টাকা। এখন এসে দেখি ৭০০ টাকা। দাম বেশি কেন জিজ্ঞেস করলে দোকানদার রেগে গিয়ে বলে, ‘কিনলে কিনেন, না কিনলে যান, এত কথা কীসের? আমাদের খরচ বেশি, তাই আমরা বেশি দামে বিক্রি করতেছি।’

তিনি বলেন, হুট করে কেন মাংসের দাম বাড়লো, তার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু গরুর মাংসই না, সবকিছুর দাম আবার বেড়ে গেছে। সামনে রমজান মাস। জানি না জিনিসপত্রের দামের কী হয়! সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে আমাদের মতো মানুষের ঢাকা শহরে বেশি বেকায়দায় পড়তে হবে। গত কয়েক বছর ধরে এভাবে যার যা ইচ্ছা জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। তাহলে সরকারের কাজ কী?