তরুণদের নিয়ে আক্ষেপের অন্ত নেই বইমেলায় আসা প্রবীণদের

‘আশি-নব্বইয়ের দশকে বইমেলায় আসার আগে তালিকা করে আসতাম কী কী বই কিনবো। কোন লেখক কত ভালো লেখেন—এমন বিষয় নিয়ে বন্ধু, ক্যাম্পাসের বড় ভাই এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করতাম। সাহিত্য, রাজনীতি বা ইতিহাসের বই কারা কারা ভালো লেখেন—এসব জেনে, শুনে, বুঝে তালিকা করে তারপরে বন্ধুরা দলবেঁধে বই কিনতে বইমেলায় আসতাম। এখন আর সেই সময় নেই, এমন দৃশ্য দেখাও যায় না।’

বইমেলার পঞ্চম দিন সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বিকালে মেলা প্রাঙ্গণে সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মাকে নিয়ে লেখা ‘কখনো আমার মাকে’ বইটি কিনতে এসে বইমেলার একাল-সেকাল নিয়ে এসব কথা বলেন প্রবীণ ব্যাংকার আব্দুস সামাদ। 

বই পড়া নিয়ে তরুণ প্রজন্মের অনীহার কথা উল্লেখ করে হতাশা প্রকাশ করে প্রবীণ এই ব্যাংকার বলেন, নব্বইয়ের দশকে যখন বইমেলা হতো তখন আমরা প্রতিদিন আসতাম। বইমেলাকে তখন আমাদের কাছে ঈদ মনে হতো। তখনকার পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তখন আমাদের চারপাশে যতদূর চোখ যেতো সবাইকে দেখতাম লিস্ট দেখে খুঁজে খুঁজে বই কিনছে। বন্ধুরা মিলে ভাগে-যোগে বই কিনতাম আমরা। mela

বইমেলায় আসা তরুণদের নিয়ে আক্ষেপ জানান মেলায় আসা ফাহমিদা খাতুন (৫৬) ও আশরাফ আলী (৬৪) দম্পতি। বাংলা ট্রিবিউনকে তারা বলেন, মেলায় একদল যুগল আসেন শুধু ছবি তুলতে আর সেলিব্রেটিদের সঙ্গে সেলফি তুলতে। একজন সেলিব্রেটি এলে স্টলে বই কেনার হিড়িক পড়ে যায় অথচ এর আগে বই কেনার কোনও নাম-গন্ধ থাকে না। আশরাফ বলেন, অবশ্য এখানে তরুণ লেখকদেরও ব্যর্থতা রয়েছে। আমি তরুণ বেশ কয়েকজনের বই কিনেছি। কিন্তু তেমন কোনও লেখকের বই মনে দাগ কাটেনি। দুই-একজন আছেন ব্যতিক্রম, বাকি সবার লেখা প্রেম-ভালোবাসার কেচ্ছা-কাহিনী দিয়ে ভরা। তাছাড়া এখন তাদের সবাই মধ্যে সেলিব্রেটিদের সঙ্গে সেলফি তোলায় ব্যতিব্যস্ত। তারা বই কেনে সেলফি তোলার জন্য।

তরুণদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা গড়ে তোলা নিয়ে এই দম্পতি আরও বলেন, আমাদের সময়ে যখন একে-অপরকে কিছু গিফট করার কথা আসতো তখন আলোচনা করতাম কোন বইটা গিফট করলে ভালো হবে। সম্পর্ক অনুযায়ী বই উপহার দিতাম। জন্মদিন হোক, নতুন প্রেম হোক বা বিয়ে হোক অথবা চাকরি হোক—যা কিছু উপহার দিতাম, পাশাপাশি বই থাকতো। এখন বই গিফট করার প্রচলন খুবই কমে গেছে। নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাদের উচিত একে-অপরকে বই গিফট করা। m4

অষ্টম শ্রেণির অতুলীকে নিয়ে স্টলে ঘুরে ঘুরে বই দেখছিলেন বাবা নেছার উদ্দিন (৪৫)। জনপ্রিয় লেখক ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মোশতাক আহমেদসহ বেশ কয়েকজন লেখকের বই সংগ্রহ করেছেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, তরুণদের চোখে এখন নতুন বই নিয়ে সেই উন্মাদনা দেখি না। একটা সময় আমরা স্টলে দাঁড়িয়েই বইয়ের এক-তৃতীয়াংশ পড়ে ফেলতাম। এখন যারা বই কিনতে আসে তারা বই কেনে, তবে সেটা লেখক আসার পর।

এই প্রজন্মের তরুণদের বই পড়ার অভ্যাস কম বলে মন্তব্য করেছেন মেলায় ঘুরতে আসা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নিলুফার জাহান। অবকাঠামো ও সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করে এই অধ্যাপক বলেন, পাবলিক লাইব্রেরি ছাড়া ক্রমাগত সবকিছুর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা শহরে যেসব পাবলিক লাইব্রেরি আছে, অধিকাংশের বেহাল দশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে ভূরি ভূরি বিসিএস প্রার্থীদের দেখা যায়। চাকরিপ্রত্যাশী ছাড়া অন্য শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিতে আনাগোনা নেই। তরুণ প্রজন্মের যদি বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে না ওঠে তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। অবশ্য তরুণদের বই বিমুখতার আরেকটা বড় কারণ, এই প্রজন্মের তেমন কোনও মানসম্মত লেখক নেই, যার বই পড়লে আরও বেশি পড়তে ইচ্ছে করবে। সোজাসাপ্টা কথা হচ্ছে—এই প্রজন্মের বেশিরভাগ লেখক তাদের লেখনী দিয়ে তরুণদের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে অক্ষম। আরেকটা বিষয়—সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ না থাকলেও কমবেশি সবাই চাকরির বইয়ের প্রতি আগ্রহী।m5

এদিকে বইমেলার বর্তমান চিত্র নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছেন সাহিত্য অঙ্গনের মানুষজন। বাংলা একাডেমির সমালোচনা করে দর্শনার্থী এনাম ভুঁইয়া (৫৬) বলেন, বরাবরের মতো এবারের আয়োজনও অগোছালো। ভালো লাগেনি। এত স্টল আর এত ঘিঞ্জি। সুন্দর করে দাঁড়িয়ে বই দেখার সুযোগ নেই। স্টলের অবস্থান একেবারেই এলোমেলো। তথ্যকেন্দ্র থাকলেও নির্দিষ্ট স্টল খুঁজে পেতে ঘাম ঝরে যায়। আসলে বইমেলা তার আসল ক্যারেকটার হারিয়ে ফেলছে। কতিপয় ভুঁইফোড় প্রকাশনীর কারণে মেলার সৌন্দর্যও আগের মতো নেই। মেলা প্রাঙ্গণের পরিবেশও খুব নাজুক। মেলার চারপাশে কাগজের ঠোঙা, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ ময়লার ছড়াছড়ি। বিশেষ করে মেলার উত্তর পাশে আর স্বাধীনতা স্তম্ভের দক্ষিণ পাশে বসার বেঞ্চের আশপাশে ময়লা-আবর্জনা বেশি।

এই দর্শনার্থী আরও বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে কালী মন্দিরের পাশের প্রবেশমুখ দিয়ে ঢুকে কিছু দূর যেতেই চোখে পড়বে আধাখোলা ম্যানহোল। বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের পাশে এবং চারুলিপি প্রকাশনীর বিপরীত পাশে এটির অবস্থান। সতর্ক না থাকলে সেখানে ম্যানহোলে পড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। মেলা দেখে মনে হতে পারে, বাংলা একাডেমি বইমেলার বদলে বাণিজ্যিক মেলা বসিয়েছে, বাণিজ্যই যেন প্রধান!

মেলার সঙ্গে পাঠক ও ক্রেতার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি মেলায় এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন, তাহলে মেলার উদ্দেশ্য কি শতভাগ সফল বলা যাবে—আক্ষেপ করে বলেন এই দর্শনার্থী।