মেলা প্রাঙ্গণে ‘লেখক বলছি’ সেমিনার মঞ্চ

দেখেন কিন্তু শোনেন না

অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে বিশাল ত্রিপলের মঞ্চ, সেখানে চলছে একের পর এক লেখকের সঙ্গে আলাপ, কবিতা পাঠ, বই থেকে পাঠ—প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা অনায়াসে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় শোনার জায়গা মানে দর্শক সারি থাকে ফাঁকা। একই অবস্থা বাংলা একাডেমি আয়োজিত সেমিনারেরও। বিখ্যাত ব্যক্তিরা দুর্দান্ত সব বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন, কিন্তু শুনছে কে? আয়োজকদের কয়েকজন। আয়োজক প্রতিষ্ঠান বলছে—এখন এর ধরন ও উপস্থাপন না বদলালে আর কাউকে শোনানো সম্ভব না। তারা সমাধান জানলে উদ্যোগ নেন না কেন, এ প্রশ্নের যেন জবাব মেলে না।

অথচ ভিন্ন দৃশ্য যে নেই, বা শ্রোতা আনা যে অনুষ্ঠানের চলমান কাঠামোতে সম্ভব না, তা কিন্তু না। গত বুধবারের (৭ ফেব্রুয়ারি) কথাই ধরা যাক। আলোচক সাহিত্যিক দীপু মাহমুদ তার অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে ফেসবুকে বলেছেন, ‘‘সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। একুশে বইমেলার ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে কথা বলার জন্য আজকের শেষ লেখক আমি। বাংলা একাডেমি থেকে আছেন শিশুসাহিত্যিক ইমরুল ইউসুফ। মঞ্চে উঠছি। ইমরুলকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণের আলাপ? ইমরুল বললো, ২০ মিনিট। বললাম, ১০ মিনিটে শেষ করবেন। শ্রোতা আছেন সাত জন। ইমরুল মন খারাপ করে আলোচনা শুরু করেছেন। আমিও আমার কথা বলতে থাকলাম। কীভাবে লেখক হলাম, কেন লিখি, কী লিখি এসব কথা। ঘটনা ঘটলো বিস্ময়কর। শ্রোতা এসে ভরে গেছে ‘লেখক বলছি’ উঠোন। চেয়ারগুলো ভর্তি। শ্রোতারা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার ভেতরে প্রবল উৎসাহ চলে এলো। ইমরুল বললো, ভাই ৪০ মিনিট হয়ে গেছে। সবকিছু গোছগাছ করতে হবে। তারপর আরও ১০ মিনিট গেলো প্রশ্নোত্তর পর্বে। ভালো লাগলো কথা শোনার জন্য এত মানুষ উপস্থিত হন দেখে। ধন্যবাদ, বাংলা একাডেমি, পাঠদের সঙ্গে লেখকের কথা বলিয়ে দেওয়ার চমৎকার আয়োজন চালু রাখার জন্য।’’

তাহলে কীভাবে অন্যদের আলোচনা প্রাণবন্ত হয় না। লেখকদের অনেকে কানাঘুষা করেন মেলার নানান প্রান্তে বসে, ‘লেখক বাছাইয়ে আরেকটু আধুনিক হতে হবে বাংলা একাডেমিকে’। কী প্রক্রিয়ায় লেখক নির্ধারণ করা হয় প্রশ্নে বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ইমরুল ইউসুফ বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন, ভালো কাজ করছেন—এমন লেখকদের একটা লম্বা তালিকা আমরা তৈরি করে মহাপরিচালক স্যারের সঙ্গে বসে ঠিক করি। মেলার প্রথম দিন বাদে প্রতিদিন তিন চার জন করে লেখক সময় পান। সাহিত্যের প্রতিটি বিভাগ যেন উপস্থিত করা যায়, সে চেষ্টা থাকে।’

কীভাবে ভালো লেখক বাছাই করা হয়—প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অনেক বিষয় আছে, যারা নানা সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন, যারা নিয়মিত লিখছেন, যাদের লেখা সমাদৃত হচ্ছে—তাদের মধ্য থেকে ১২০ থেকে ১৪০ জন সারা মাসের জন্য বাছাই করা খুব কষ্টের।’

কিন্তু বাংলা একাডেমির বাছাই করা ভালো লেখকদের কথা কেন শুনছেন না মেলায় আসা দর্শনার্থীরা, কীভাবে এই অনুষ্ঠান জনপ্রিয় করে তোলা যায়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পঠন পাঠন ও শোনার প্রবণতা কমে গেছে। বইমেলা ইভেন্ট কাভার করতে সাংবাদিকরা আসেন, বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। গণমাধ্যম যদি আরেকটু যুক্ত হতো মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এবং কোন প্রবন্ধ পাঠ হবে বা লেখক মঞ্চে কারা থাকবেন, আগের দিন তারা যদি প্রচারের ব্যবস্থা করে, তাহলে আগ্রহীরা সেই মোতাবেক আসতে পারেন। আবার আমরা যদি উপস্থাপনাটা আরেকটু আধুনিক করতে পারি, সারা মেলায় কয়েক জায়গায় যদি প্রজেকশনের ব্যবস্থা করে অনুষ্ঠানটি দেখানো হয়, তাহলে মানুষের যুক্ততা বাড়বে।’

জনপ্রিয় করে তোলার একাধিক প্রক্রিয়া জানার পরেও বাংলা একাডেমি কেন ব্যবস্থা নেয় না, জানতে চাইলে তিনি আবারও গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান।

উল্লেখ্য, মেলা চলাকালীন প্রতিদিন একটি করে প্রবন্ধ পাঠ করা হয় পৃথক সেমিনার মঞ্চে। সেখানেও শ্রোতা মেলা ভার। এই প্রবন্ধগুলো পরের বছরের মেলায় সংকলনের বই আকারে প্রকাশ করা হয়।

সেমিনারের বিষয়ে একেবারেই প্রচার করা হয় না উল্লেখ করে বিশিষ্ট সাহিত্যিক অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘সেমিনারের ভেন্যু নিয়ে ভাবতে হবে। এটি যদি সোহরাওয়ার্দী মাঠে ব্যবস্থা করা যায়—তাহলে শ্রোতা পাওয়া যেতো। কেননা, পাঠকরা এদিকটাতেই থাকেন। আমি মনে করি, আমাদের দেশে এখনও মনোযোগী শ্রোতা আছেন। সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা আরেকটু দায়িত্বশীলতা নিয়ে যদি নিজেদের আলোচনায় তার নিজস্ব শ্রোতাদের আমন্ত্রণ জানায়, সেটাও ভালো সংখ্যক শ্রোতা আনবে।’