ইউরোপে মানবপাচারে জড়িত বিমানবন্দরের কর্তারা: ডিবির হারুন

বিমানবন্দরের বিশেষ প্রবেশের অনুমতি ব্যবহার করে কখনও ট্যুরিস্ট, কখনও ভুয়া ভিসায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ সেনজেনভুক্ত দেশগুলোয় লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা করে আসছে একটি চক্র। ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকায় বিদেশে পাঠানোর ফাঁদ পাতা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মকর্তারাও।

বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি ডিবির কার্যালয়ে অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।

তিনি আরও বলেন, চক্রটি গত দেড় বছরে আড়াই শতাধিক মানুষকে ইউরোপ পাঠানোর নামে প্রতারণা করেছে। চক্রের দুই মূল হোতাসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

ডিবি পুলিশ বলছে, আদালতের নির্দেশে একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে গ্রেফতারকৃতদের। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিন যাত্রী স্বীকার করেছের, ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা দালালদের দিয়ে অবৈধ পথে ফ্রান্স, ইতালি ও গ্রিসে যাচ্ছিলেন তারা।

তারা বলছে, চক্রের মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। শূন্য হাতে দেশে ফিরলেও ভাগ্যবদলের আশায় বিদেশে যাওয়া অনেকেই বিভিন্ন দেশে জেল খেটেছেন, কেউ এখনও রয়েছেন জেলে। তবে চক্রের দুই হোতার বক্তব্যে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ বিমানের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এই চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২ নম্বর টার্মিনালের পূর্ব পাশের গেট দিয়ে অবৈধভাবে জাল ভিসা দিয়ে তিন জনকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছিল চক্রের সদস্যরা। এমন তথ্য পেয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং এপিবিএন অভিযান চালিয়ে চক্রের দুই হোতাকে গ্রেফতার করে।

জিজ্ঞাসাবাদের পর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, মোহাম্মদ কবির হোসেন ও চক্রের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া তিন যাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন জানে আলম, সাব্বির মিয়া ও সম্রাট সওদাগর।

এ সময় চক্রের দুই সদস্যের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, ৩টি জাল ভিসা, ৪টি এনআইডি, বিমানবন্দরে প্রবেশের স্পেশাল পাস, ৪টি এটিএম কার্ড, ৫টি মোবাইল, ৩টি ই-টিকিট, ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা সংশ্লিষ্ট জাল কাগজ, ১টি ড্রাইভিং লাইসেন্স, ১৬ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমরা অনেকবারই বলেছি। বিভিন্ন পন্থায় তারা মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সেনজেনভুক্ত দেশগুলোয় যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এ জন্য সক্রিয় রয়েছে দালাল চক্র।

তিনি আরও বলেন, এখন দালাল চক্রের সদস্যরা কৌশল ব্যবহার করছেন। তারা বাংলাদেশ বিমানের নিরাপত্তা সদস্য, কুয়েত এয়ারওয়েজের বুকিং সহকারী, কিছু জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠান ও ট্রাভেল এজেন্সিসহ কিছু দক্ষ কম্পিউটার অপারেটর মিলে শক্তিশালী একটি চক্র গড়ে তুলেছে। চক্রটি ট্যুরিস্ট ভিসার কথা বলে এসব দেশে কোনোরকমে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ‘এরপর পৌঁছে গেলে আর ফেরত আসতে হবে না’—এই বলে কারও কারও কাছ থেকে ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

জড়িত সদস্যদের বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দাপ্রধান আরও জানান, চক্রটির কাজ হচ্ছে বিমানবন্দরে কোনও রকমে ঢুকিয়ে দেওয়া। ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট করে দেয়। সেই টিকিট পেয়ে তারা বিমানবন্দরে প্রবেশ করে। বোর্ডিং পাস আনতে গেলে বাংলাদেশ বিমানের নিরাপত্তা সদস্য ও কুয়েত এয়ারওয়েজের বুকিং সহকারীর নজরে আসে। তারা তো ‘বায়াজড’, বলে সব ঠিক আছে। ইমিগ্রেশনেও চেক করা হয় না। বিদেশগামী ভুক্তভোগীরা কিছু না বুঝে ভুয়া বোর্ডিং পাস নিয়ে বিমানে উঠে চলে যায়।

হারুন বলেন, এভাবে বাংলাদেশ থেকে তারা গেলেও অনেক সময় তারা ট্রানজিট পয়েন্টে আটক হয়, কখনও সর্বশেষ ফ্রান্স, জার্মান অথবা ইউরোপে গিয়েও আটক হন। কারণ এসব জায়গায় চেক করতে গিয়ে দেখে কাগজপত্র ভুয়া। তখন কাউকে দেশে ফেরত পাঠায়, কাউকে জেলে পাঠায়। যারা জেলে যায়, পরে তাদের কেউ কেউ কাজও পেয়ে যায়। চক্রের সদস্যরা এই সুযোগটি নেয়। 

এই প্রতারণায় জড়িত কিছু জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেলস এজেন্সি, এয়ারলাইনস ও কম্পিউটার অপারেটর মিলে এসব করছে। গতকাল একই কায়দায় ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠানোর চেষ্টাকালে খবর পেয়ে এপিবিএন ও ডিবি পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে।

ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান আরও বলেন, ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা বারবার বলছি, সাবধান করছি। জালিয়াতি বা প্রতারণার খপ্পরে পড়ছি কিনা, তা চেক করার জায়গা তো আছে। চেক করলে, ভেরিফিকেশন করলেই তো বোঝা যায়।

বিমান বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার সন্দেহ নিয়ে তিনি বলেন, এই কাজে যারা জড়িত, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা বলেছে, এয়ারলাইন্সের সিনিয়র কর্মকর্তা, সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার, সুপারভাইজাররা জড়িত থাকতে পারে। যদি জড়িতই না থাকবে, তাহলে কীভাবে অনায়াসে বোর্ডিং পাস দিয়ে দেয়? তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। অবৈধ লোকদের ব্যাপারে তারা কেন কঠোর হয় না, টিকিট বোর্ডিং পাস পেয়ে যাচ্ছে, বিদেশেও চলে যাচ্ছে। দেড় বছরে আড়াইশ’ মানুষকে অবৈধভাবে পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, পুরো চক্র মিলে আড়াইশ’ মানুষকে খপ্পরে ফেলে ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠিয়েছে। যাদের অনেকে মানবেতর জীবনযাপনের পর দেশে ফিরে এসেছে। কেউ এখনও জেল খাটছে। চক্রটির সঙ্গে বিমানের সিনিয়র কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারে বলে আমাদের ধারণা। আমরা অবশ্যই তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক দালাল চক্রের সদস্যরাও রয়েছে।.

যদি বাংলাদেশ বিমানের ঊর্ধ্বতন কোনও কর্মকর্তা জড়িত থাকেন, তাহলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে হারুন বলেন, বিমান বাংলাদেশের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে অনেক কিছু আমরা তদন্ত করেছি। আমরা তদন্তের বাইরে এক পা-ও পিছু হইনি। তদন্ত শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশা করছি সবাইকে আইনের আওতায় আনতে পারবো।