বমি করার প্রশিক্ষণ দিয়ে নামানো হয় ছিনতাইকারী!

ছিনতাইয়ের জন্য প্রতিদিন নিত্যনতুন কৌশল বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। দিনে-রাতে নানা কৌশলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করে চলেছে তারা। শুধু টাকা বা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়েই শান্ত হয় না, অনেক সময় ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত করে ভিকটিমকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। বিভিন্ন সময় এসব ছিনতাইকারী চক্রের শত শত সদস্যকে গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবুও থামছে না এই অপরাধ। বরং ছিনতাই করতে নিত্যনতুন অভিনব কৌশল বেছে নেওয়া হচ্ছে।

অনলাইনে পণ্য বিক্রেতাদের টার্গেট করে ছিনতাই, পুলিশ পরিচয় দিয়ে তল্লাশি করার নামে ছিনতাই, মারামারি লাগিয়ে ছিনতাই, মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ দিয়ে অজ্ঞান করে ছিনতাই– এমন বহু কৌশলে ছিনতাইয়ের তথ্য জেনেছে পুলিশ। তারা বলছে, বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসের যাত্রীদের ওপর বমি করে দিয়ে এরপর টার্গেটের সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়ার একটি কৌশল সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। এই কাজে বাসচালক ও সহকারীদের জড়িত থাকারও প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ও এ চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর বিষয়টি ফের সামনে আসে। জানা গেছে, যখন তখন কীভাবে চেষ্টা করে বমি করতে হবে রীতিমতো তার প্রশিক্ষণ দিয়ে নামানো হচ্ছে ছিনতাইকারীদের।        

গত ২৯ জানুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে বিমানবন্দরের কাছে এসে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন মো. মামুন মির্জা। গন্তব্য বাড্ডা এলাকা। বাসে উঠে বসে পড়েন মাঝখানের একটি সিটে। এয়ারপোর্ট থেকে বাস ছাড়ার কয়েক মিনিট পর এক ব্যক্তি তার কাঁধের ওপরে বমি করে দেয়। এরপরই তাকে ঘিরে চলন্ত গাড়িতে তৈরি হয় জটলা। এরইমধ্যে তার কাছে থাকা ৪০ হাজার টাকা পকেট কেটে নিয়ে যায় বমি পার্টির সদস্যরা।

মামুন মির্জা বলেন, এয়ারপোর্ট থেকে বাসটি খিলক্ষেত ঢুকলে এক ব্যক্তি হঠাৎ করে আমার কাধের ওপর বমি করে দেয়। এসময় আসন থেকে আমি উঠে দাঁড়াই। বমি পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। ঠিক এসময় নিচে রাখা আমার ব্যাগটি পাশের আরেক ব্যক্তি সরাতে যায়। ব্যাগটি আমি ধরতে নিচে ঝুঁকলে কিছুক্ষণ পরই আমার পকেটের এক পাশ ছেঁড়া দেখতে পাই। এরাই আমার সঙ্গে থাকা ৪০ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

একই দিনে ওই এলাকায় আরেকজনের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে। এভাবে অনেকের নগদ টাকা, মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে ছিনতাইকারী বা বমি পার্টির সদস্যরা।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও থানার ফার্মগেটের খামারবাড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সামনে থেকে এমনই একটি চক্রের সদস্য সন্দেহে দুই জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার দুই জন হলো– সুমন আল হাসান (২৯) ও মো. আবুল হোসেন (৪০)। তাদের কাছ থেকে ছিনতাই করা ২০ হাজার টাকা ও দুটি ছুরি উদ্ধার করা হয়। তারা জানায়, যাত্রীবেশে বাসে উঠে টার্গেট করা যাত্রীর শরীরে বমি করে কৌশলে টাকা, মোবাইল ফোন হাতিয়ে নিতো। তাদের সঙ্গে কিছু গাড়িচালক ও হেলপার জড়িত। ছিনতাইয়ের ভাগ যেতো তাদের পকেটেও।

পুলিশ জানায়, গ্রেফতার দুইজন রাজধানীর চিহ্নিত ছিনতাইকারী। তাদের গ্রুপে মোট পাঁচ জন রয়েছে। কেউ তাদের একজনকে দেখে ফেললে বা ধরে ফেললে বাকি সদস্যরা ওই ব্যক্তিকেই ছিনতাইকারী বলে মারধর করে পালিয়ে যেতো। কেউ ধরা পড়লে ছুরির ভয় দেখিয়ে পালিয়ে যেতো বাকি সদস্যরা।

এ চক্রের এক সদস্য মো. স্বপন (৫২)। বাসে যাত্রীবেশে উঠে বমি করে যারা ছিনতাই করে তাদের কাছে ‘গুরু স্বপন’ নামে সে পরিচিত।  ২১ ফেব্রুয়ারি ফার্মগেট খামারবাড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সামনে থেকে তাকে গ্রেফতার করে তেঁজগাও থানা পুলিশ। এসময় তার কাছ থেকে একটি ছুরি এবং ছিনতাই করা ৮০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ জানায়, স্বপন বরিশাল জেলার কাজিরহাট থানার সন্তোষপুর গ্রামের মৃত আয়নাল ফকিরের ছেলে। সে চিহ্নিত ছিনতাইকারী। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে ১০টি মামলা রয়েছে। সে একসময় চুরি করতো। চুরির অভিযোগে বেশ কয়েকবার আটকও হয়। এ কারণে গ্রামে সবাই ‘চোরা স্বপন’ নামে চেনে। গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে সে ছিনতাই শুরু করে। পরে নিজেই দল করে নেয়। তৈরি করে ‘বমি পার্টি’।

রাজধানীতে খামারবাড়ি হয়ে বাংলামোটর-মগবাজার-কমলাপুরের দিকে নিয়মিত যাতায়াত করে লাভলী পরিবহন নামে একটি বাস। বাসের হেলপার বিপ্লব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা সারাদিন কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলি। যেসব চালক হেলপার সব দেখেও কিছু বলে না তারা তো অপরাধীদের মতোই। আমরা চাই তাদেরও খুঁজে বের করা হোক।

এ প্রসঙ্গে ডিএমপির তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা বমি পার্টির দুটি চক্রের সন্ধান পেয়েছি। দুইটি চক্রের ১০ জন সদস্য রয়েছে। ইতোমধ্যে চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছি।

তিনি জানান, চক্রটি যে বমি করে সেটা কৃত্রিম। চকলেট ও পানির বিশেষ মিশ্রণে এই কৃত্রিম বমি করা হয়। কৃত্রিম এই বমি সবাই করতে পারে না। এই বমি করার প্রশিক্ষণ দেয় স্বপন। এছাড়া তারা নিয়মিত যেসব রোডে চলাচল করে এসব রোডের কিছু বাসের চালক ও সহকারীদের সঙ্গে শখ্য গড়ে উঠে। দেখা গেছে তাদের চিনতে পারলেও তারা কিছু বলে না। চক্রটি মিরপুর, উত্তরা, ফার্মগেট রাজধানীর আরও বিভিন্ন স্থানে এভাবে ছিনতাই করে আসছিল।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার  উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছিনতাইকারীরা একেক সময় একেক রকম কৌশল বেছে নেয়। লোকজনের শরীরের ওপর বমি সব ছিনিয়ে নেওয়া সেটাও এদের একটি কৌশল। তবে যে কৌশলেই ফলো করে তারা অপরাধ করে না কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তারা ধরা পড়বেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিটি জোনেই এদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। আমাদের অভিযান ও নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।