১৪ বছরে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ২৫৩৬ জন, দায় কার?

২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৪ বছরে সারা দেশে আগুনের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৫৩৬ জন। এই মিছিলে বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) বেইলি রোডের ঘটনায় যোগ হয়েছে আরও ৪৫ জনের নাম। বড় বড় দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়ন যেমন করা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকির শঙ্কা রয়েছে এমন অনেক ভবন চিহ্নিত করার কাজও সংস্থাটি করছে। কিন্তু যখনই বড় কোনও আগুনের ঘটনা ঘটে তখনই জানা যায়, সেই ভবনের অগ্নিঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল, বা ভবন ত্রুটিপূর্ণ সেই বিষয়ে নোটিশ দেওয়া ছিল। তারপরও আগুনের ঘটনা ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। তাহলে সেই দায় কার, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

রাজধানীর বেইলি রোডে যে ভবনটিতে আগুন লেগে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেটিতে রেস্তোরাঁ করার অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ, একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। ছিল ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম এবং পোশাক বিক্রির দোকানও। নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, অফিসের অনুমতি নিয়ে রেস্তোরাঁ খুলে ফেলার কোনও সুযোগ নেই। কারণ বাণিজ্যিক রেস্তোরাঁর কিচেনের ধরন আলাদা। যেকোনও কিচেনে আপনি এটা পরিচালনা করতে পারবেন না। আর এই পরিবর্তনগুলো মনিটরিংয়ে টাস্কফোর্স অনিবার্য। বারবার বলার পরেও এসব বিষয় কেউ কানে তোলে না। আর ফায়ার সিভিল ডিফেন্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নোটিশ দিয়েই ফায়ার সার্ভিস তার কাজ সারলে পরিবর্তন আসবে না। আগুন নির্বাপণ ও উদ্ধারের চেয়ে আগুন প্রতিরোধে মনোযোগ দিতে হবে।

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভেতরের চিত্র (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

ঘটনার পর রাজউক যেমন বলছে—যে ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পোশাকের দোকানের অনুমোদন ছিল না, তেমনি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও বলছে, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বেইলি রোডে পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভবনটিতে কোনও অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘দায় অবশ্যই মালিকপক্ষকে নিতে হবে। অনুমোদন নিচ্ছি একটা আবাসিক ভবনের, সেটা বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক কিচেনের নকশা জটিল বিষয়। অনুমোদনের পরে এই পরিবর্তন যারা করেন, দায় অবশ্যই তাদের। এরপর দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। যারা অনুমোদন দিচ্ছেন, তারা জানেন—আমাদের দেশে এরকম পরিবর্তন অহরহ হয়। সেক্ষেত্রে বারবার বলার পরেও টাস্কফোর্স তৈরি করেন না কেন? একটি নিরপেক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টাস্কফোর্স তৈরি হবে, যারা দেখবে অনুমোদন পরবর্তী কী কী ঘটছে। নিয়মিত তদারকি, অভিযানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন মনিটরিং করতে হবে। সেটা না করে একটা ঘটনা ঘটছে, আর আমরা অপেক্ষা করি পরেরটা কবে হবে।’

এর আগে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার। বারবার নোটিশ দেওয়ার পরেও কেউ আমলে নেয়নি বলে সেসময় অভিযোগ করেন ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা।

ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিতে একটি রেস্টুরেন্টের বর্তমান চিত্র (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ মনে করেন, ‘যারা মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, দায় তাদের নিতে হবে। কোনও একটি ঘটনা ঘটলেই জানা যায়, সেখানে যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না। সেটা যাদের মনিটর করার কথা, তারা কোথায়? আর মনিটর করা শেষে যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেন, তাহলে এসব বন্ধ হবে না।’

ফায়ার সার্ভিস ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে নোটিশ পাঠায়। কিন্তু এর বাইরে করণীয় আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ফায়ার থেকে নোটিশ পাঠানো হয়, লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে হবে এবং তার পরের স্তরে কী করবেন, সেটা জানাতে হবে। কোনও ভবনে আগুন যেন না লাগতে পারে, আগুন নির্বাপণের সরঞ্জাম ঠিক আছে কিনা এসব দেখার আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগের উইং দুর্বল। সেক্ষেত্রে কেবল নোটিশ না দিয়ে, সেই নোটিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। একের পর এক অভিযান চালিয়ে দেখেছে কখনো? ফায়ার সার্ভিসের অন্যতম কাজ আগুনের বিরুদ্ধে ফাইট করা ও ভিকটিম বা ভুক্তভোগীদের উদ্ধার করা। কিন্তু বড় কাজ হওয়া উচিত আগুন যেন না লাগে, সেটা নিশ্চিত করা। সেটা নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় সেটা যেন সে করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। তা না হলে আমরা একে অপরকে দায়ী করতে থাকবো।’

ক্ষতিগ্রস্ত ভবন (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

তিনি বলেন, ‘ভবন মালিকদেরও দায় নিতে হবে। তারা নিজেদের সংবেদনশীল লোক দাবি করতে পারেন না; ব্যবসা করতে গিয়ে নিয়ম-কানুনের ধার ধারেন না। কেন তাদের মনে হবে না— আমি নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করলে এত মানুষের মৃত্যুর কারণ আমিই হবো।’