বেইলি রোড ট্র্যাজেডি

ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল ‘এএমপিএম’, পলাতক কর্মকর্তারা

রাজধানীর বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’-এ অগ্নিকাণ্ড ও ৪৬ জন নিহতের ঘটনায় ভবনটির ব্যবস্থাপনার নানা গলদ সামনে এসেছে। দেশের শীর্ষ রিয়েল এস্টেট কোম্পানি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ ভবনটি নির্মাণ করে। আর ভবনটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে একই প্রতিষ্ঠানের সিস্টার কনসার্ন ‘এএমপিএম (আমিন মোহাম্মদ প্রোপার্টি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস) প্রাইভেট লিমিটেড’। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা প্রধান ছিলেন অন্য একজন কর্মকর্তা, যিনি ঘটনার পর ‘আত্মগোপনে’ চলে গেছেন।

ভবনটির আশপাশের দোকানি ও ভবন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তারা জানান, ২০১৫ সালে ভবনটির নির্মাতা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ ফ্ল্যাট হস্তান্তর করে। আর দেখভালের দায়িত্বটি রেখে দেওয়া হয় এই প্রতিষ্ঠানের অধীনেই। ‘এএমপিএম প্রাইভেট লিমিটেড’ ভবনটির সিকিউরিটি, সেফটি, গার্ডস ও লিফট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিল।

রাজউকের একটি সূত্র জানায়, ভবনটির ছয় তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অফিস হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি ছিল। ছয় ও সপ্তম তলা ছিল আবাসিক হিসেবে ব্যবহারের অনুমতিপ্রাপ্ত। নির্মাণের পর ২০১৫ সালে মালিকানা হস্তান্তর করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। জমির মালিক ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে দেয়। পরে সপ্তম তলার স্পেসটি (অন্তত ১৬০০-১৮০০ স্কয়ার ফুট) আবারও কিনে নেয় এএমপিএম প্রাইভেট লিমিটেড।

ভবনের ফ্ল্যাট মালিক অ্যাসোসিয়েশনের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সপ্তম তলার স্পেসটি কয়েক মাস আগে ‘হাক্কাঢাকা’ নামে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টকে ভাড়া দেওয়া হয়। যদিও ওই ফ্লোরটি ‘আবাসিক হিসেবে’ ব্যবহারের অনুমতি ছিল রাজউকের।

এ বিষয়ে ডিএমপির রমনা জোনের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ সালমান ফার্সী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রিন কোজি কটেজের স্বত্বাধিকারী আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ এবং ভবনটির ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল (৪৫)। তাকে শনিবার (২ মার্চ) দুপুরে আমরা আটক করেছি।’

পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেফতার বিপুলকে ভবনের ‘ম্যানেজার’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও মূলত তিনি ‘এএমপিএম’র সুপারভাইজার। তিনি ভবনের কোনও ম্যানেজার নন।

রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, মিডিয়ায় বিপুলকে ‘ম্যানেজার’ বলা হলেও আদতে তিনি সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতেন। সূত্রটি আরও জানায়, শনিবার পর্যন্ত আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের অন্তত ৮ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে বিপুলকে আদালতে চালান দেওয়া হয়েছে।

মোহাম্মদ সালমান ফার্সী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, জমির মালিক নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য তিনি পাননি।

আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের প্রধান কার্যালয়, ছবি: সাজ্জাদ হোসেনব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল এএমপিএম

‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের সূত্র জানায়, ভবনের ভেতরে বেশ কয়েকটি ফ্লোরে ‘ভয়েড’ (ভবনে আলো-বাতাস আসার স্পেস) ছিল, সেগুলো বন্ধ করে স্পেস বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে আলো-বাতাসের প্রবাহ বন্ধ থাকায় অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। স্পেস বাড়িয়ে ব্যবহার করার সুযোগ করতেই ‘ভয়েড’ বন্ধ করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবু আনছার শনিবার রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভবনের ফ্ল্যাট মালিক অ্যাসোসিয়েশনের বিষয়টি আমরা অনুসন্ধান করছি। কাউকে এখনও খুঁজে পাইনি।’

বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টার দিকে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজে’ আগুনের সূত্রপাত ঘটে। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ভবনের নিচতলায় সিঁড়ির পাশে চায়ের দোকান ‘চুমুক’-এ রাখা গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভবনটির সিঁড়ির প্রায় বেশিরভাগ অংশ দখল করে ‘চুমুক’র গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা হতো। ওই সুযোগটিও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। যে কারণে কোনও বাধা ছাড়াই গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো সিঁড়ির পাশে রেখে ব্যবসা চালিয়ে এসেছে ‘চুমুক’।

শুক্রবার (১ মার্চ) বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসাব) জেনারেল সেক্রেটারি জাকির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভবনটিতে যে ফায়ার অ্যালার্মিং ও অগ্নিনিরাপত্তা থাকার কথা, তার ন্যূনতম ব্যবস্থাও ছিল না। প্রতিটি ফ্লোরে ওঠার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল সংকুচিত। আর যা ব্যবস্থা ছিল সেটিও ব্যবহার করতে পারেনি কেউ।’

‘ফলে নিচ থেকে ওপরের দিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ইমারজেন্সি কোনও দরজা ছিল না। সিঁড়ির পাশেই গ্যাস সিলিন্ডার পড়ে থাকতে দেখেছি। এমনকি অগ্নিনির্বাপণের যে যন্ত্রগুলো রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি’, বলেন ‘ইসাব’ জেনারেল সেক্রেটারি জাকির উদ্দিন আহমেদ।

পলাতক কর্মকর্তারা

বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পরই নির্মাতা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত ৮-১০ জন কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও তাদের কারও নম্বর খোলা পাওয়া যায়নি।

শুক্রবার (১ মার্চ) রাতে ঢাকার বিমানবন্দরে কর্মরত গোয়েন্দা ও ইমিগ্রেশনের নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, শুক্রবার ভোরে টার্কিশ এয়ারলাইন্সে ঢাকা ত্যাগ করেন আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক।

শনিবার (২ মার্চ) রাজধানীর ধানমন্ডিতে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের হেড অফিসে কোনও বড় কর্মকর্তাই যাননি। সরেজমিন শনিবার বেশ কয়েকবার বিভিন্ন সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে সেখানে।

প্রভাবশালী একটি সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ভবন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ‘এএমপিএম’ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ও আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের যুক্ততা তদন্ত করছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে রাতে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ তানভীরুল ইসলামকে ফোন ও মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনও সাড়া দেননি। পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।

পরে প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবী জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন শোনার পর তিনি বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি একটু ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলবো।’

শনিবার আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের জনসংযোগ প্রধান গাজী আহমেদ উল্লাহ্ গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘বিল্ডিংয়ের মালিক আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ নয়। শুধু জয়েন্ট ভ্যানচারে নির্মাণ কাজটি (ডেভেলপার হিসেবে) আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ সম্পন্ন করেছে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় রাজউকের বিল্ডিং কোডসহ সংশ্লিষ্ট সব নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালে অর্থাৎ ৯ বছর আগে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হলে মালিকানাও হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে ভবনটির কার্যক্রম পরিচালনাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার অ্যাসোসিয়েশন।’

আরও পড়ুন:

বেইলি রোডের ট্র্যাজেডি নিয়ে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের বিবৃতি