গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিভে যায় নারী-শিশুসহ ৪৬ জনের প্রাণ। ব্যস্ত নগরীর সেই ভবনের আগুন নিভে গেলেও ক্ষত মুছে যায়নি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর। তীব্র কষ্ট বুকে নিয়ে এখনও নানাভাবে স্মরণ করছেন তাদের প্রিয়জনকে। একই সঙ্গে তারা শুনিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রতি আক্ষেপ ও হতাশার কথা। এ ঘটনার বছর ঘুরলেও এখনও জমা পড়েনি তদন্ত প্রতিবেদন। শিগগিরই জমা দেওয়ার কোনও আশাও দিতে পারেননি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ফলে আইনের ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলায়’ পরিণত হওয়ার শঙ্কায় পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
জানা গেছে, এ আগুনের ঘটনায় তৎকালীন রমনা মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম ভবনের মালিক, রেস্টুরেন্টের মালিক ও ব্যবস্থাপকদের অবহেলা এবং রাজউকের নিয়মবহির্ভূত কাজকে দায়ী করে ৩০৪-ক/৩০৭/৩৩৮/৪৩৬/৪২৭/১০৯/৩৪ ধারায় চার জনকে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত আরও অনেককে আসামি করে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় এ পর্যন্ত আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে মামলার আট জনই বর্তমানে জামিনে আছেন। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে সিআইডি। সবশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের তারিখ পিছিয়ে আগামী ১১ মার্চ নির্ধারণ করেছেন আদালত।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন– জেস্টি রেস্টুরেন্টের মোহর আলী পলাশ, কাচ্চি ভাইয়ের মালিক মো. সোহেল সিরাজ, ব্যবস্থাপক জইন উদ্দিন জিসান, ফুকো চেইন রেস্টুরেন্টের আব্দুল্লাহ আল মতিন, ভূমি মালিক কেএম নাসিম হায়দারের পক্ষে বাড়ির কেয়ারটেকার নজরুল ইসলাম খান, ভবনের ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল, চুমুক রেস্টুরেন্টের মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে রমনা মডেল থানাধীন নিউ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামক সাততলা ভবনের নিচতলার ‘চুমুক’ নামের রেস্টুরেন্ট থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এবং প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ও ধোঁয়া পুরো ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা রেস্টুরেন্টে আগত নারী, পুরুষ, শিশু এবং অন্যান্য দোকানে আগত ক্রেতা ও ভবনের কর্মরত লোকজনের শোর-চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য আর্তনাদ এবং প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষের দ্রুত ছোটাছুটি এবং উৎসুক জনতার কারণে ভবনের আশপাশের এলাকায় প্রচুর লোকজনের সমাগম হয়। এ ঘটনায় মোট ৪৬ জন মারা যান।
এজাহারে আরও বলা হয়, ভবনটিতে কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট এবং দোকান ভাড়া দেয়। ওই রেস্টুরেন্টগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যতিরেকে রান্নার কাজে গ্যাসের সিলিন্ডার এবং চুলা ব্যবহার করে। রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য ভবন স্বত্বাধিকারী এবং ম্যানেজারের যোগসাজশে ‘চুমুক ফাস্ট ফুড’, ‘কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট’, ‘মেজবানী রেস্টুরেন্ট’, ‘খানা’স ফ্ল্যাগশিপ’, ‘স্ট্রিট ওভেন’, ‘জেস্টি’, ‘হাক্কা ঢাকা’, ‘শেখ হলি’, ‘ফয়সাল জুসবার (বার্গার)’, ‘ওয়াফেল বে’, ‘তাওয়াজ’, ‘পিজ্জা ইন‘, ‘ফোকো’ ও ‘এস্ত্রোশিয়া’ নামের রেস্টুরেন্ট মালিকরা ভবনটির নিচতলায় বিপুল পরিমাণে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করে এবং জননিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়া ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ এবং বিপজ্জনকভাবে এই গ্যাস ব্যবহার করে আসছিল।
ভবনটির নিচতলায় থাকা রেস্টুরেন্টের রান্নার কাজে ব্যবহার করা গ্যাস অবহেলা ও অসাবধানে মজুত করে রাখা হয় উল্লেখ করে অভিযোগে আরও বলা হয়, এই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয় এবং এই আগুনের তাপ ও প্রচণ্ড ধোঁয়া পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে বিভিন্ন ফ্লোরে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ও দোকানে অবস্থানকারী লোকজন আগুনে পুড়ে ও ধোঁয়া শ্বাসনালিতে ঢুকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান এবং গুরুতর আহত হন বলে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়।
প্রাথমিকভাবে আরও জানা যায়, ভবনটি আবাসিক ভবন হিসেবে নির্মিত হলেও পরবর্তী সময়ে আসামিরা ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাণিজ্যিক সনদ সংগ্রহ করেন। ভবনটির যেসব ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট আছে, সেসব রেস্টুরেন্টের মালিকরা রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বা চুলা ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ফায়ার সার্ভিস অফিস থেকে কোনও অনুমতিপত্র গ্রহণ করেননি। এছাড়াও তারা অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইসারসহ অন্যান্য ফায়ার ফাইটিং যন্ত্রপাতি রাখেনি। এমনকি ভবনে ফায়ার এক্সিট সিঁড়িও নেই।
স্থানীয়ভাবে জানা যায় যে, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির স্বত্বাধিকারী আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপ এবং ভবনটির ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল (৪৫)। ‘চুমুক ফাস্ট ফুড’ এর মালিক আনোয়ারুল হক (২৯), ‘কাচ্চি ভাই’ নামীয় রেস্টুরেন্টের মালিক মো. সোহেল সিরাজ (৩৪)।
গ্রিন কোজি কটেজের স্বত্বাধিকারী ও ব্যবস্থাপক, অন্যান্য রেস্টুরেন্টগুলোর মালিক ও ব্যবস্থাপকদের কাছে ভবন ব্যবহারের যথাযথ নিয়ম অমান্য করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম করার জন্য ভাড়া দিয়েছে। আসামিরা ও অন্যান্য রেস্টুরেন্টের মালিক বা ব্যবস্থাপকরা যথাযথ নিয়ম ছাড়াই রাজউকের দোকান পরিদর্শক অফিসারদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রেস্টুরেন্ট স্থাপন করে, গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। ভবন স্বত্বাধিকারীর এমন অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়া ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজের জন্য গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে সৃষ্ট আগুনে দগ্ধ হয়ে ও শ্বাসনালিতে ধোঁয়া প্রবেশ করে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ৪৬ জন মানুষের নির্মম মৃত্যু ঘটেছে এবং আরও বহুসংখ্যক মানুষ আগুনে পুড়ে এবং ধোয়ায় আক্রান্ত হয়ে শ্বাসনালিসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুড়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন এবং মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। এ ঘটনায় গ্রিন কোজি কটেজ ভবনসহ আশেপাশের ভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক মানুষের মূল্যবান সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মামলার অগ্রগতির বিষয়ে সিআইডির পরিদর্শক শাহজালাল মুন্সী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলমান। আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাসখানেক আগে রাজউক ও আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের কাছে আমরা কিছু রিপোর্ট চেয়েছি। কিন্তু তারা সেগুলো এখনও আমাদের দেননি। কবে নাগাদ দিতে পারবেন? সেটাও জানি না। রিপোর্ট না পেলে তদন্ত কাজ আগানো কঠিন। রিপোর্ট পেলে আরও কিছু কাজ থাকবে, সেগুলো শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।’
আগামী ১১ মার্চের শুনানির দিনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বললেন, ‘আমরা ১১ মার্চ বা আরও পরে কবে দিতে পারবো, জানি না। তদন্ত শেষ হলেই আমরা প্রতিবেদন জমা দেবো।’
স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ ইতালি প্রবাসী মোবারক কাউসার নামে এক ব্যক্তি ওইদিন রেস্টুরেন্টে খেতে যান। দুর্ঘটনায় তার পরিবারের সবাই মারা যান। এ বিষয়ে মোবারকের ছোট ভাই আমির হামজা বলেন, ‘আমার ভাই তার সন্তানসহ মারা গেছেন। আমরা জানতাম না, ভবনগুলো এরকম বিপজ্জনক। এটা দেখার দায়িত্ব ছিল সরকারের। অথচ সরকার তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেনি। পরিবার হারানোর পর, সরকারের কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমাদের সমবেদনাও জানায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় পর আমরা মনে করেছি, রাষ্ট্র আইনিভাবে আমাদের পক্ষে লড়বে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। গত কয়েক মাস আগে রমনা থানার পুলিশের একজন সদস্য বলেছিলেন, অনুসন্ধানের জন্য আমাকে ফোন করবেন। পরে আর কথা হয়নি। এক বছর পার হয়ে গেলো, আমার ভাই নেই। ভাতিজা, ভাতিজি নেই। এখনও আসামিদের কোনও বিচার হয়নি।’
মেয়ে ও ভায়রার পরিবারসহ ছয় আত্মীয়কে হারিয়েছেন আব্দুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়ে ছিল নুসরাত জাহান নিমো। আল্লাহ সেটিও নিয়ে গেলেন। সে সিটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ওইদিন ওর পরীক্ষার প্রবেশপত্র দিয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল এইচএসসির পর মালয়েশিয়া পড়তে যাবে। আমার ভায়রাদের কয়েকদিন পরই বিদেশে চলে যাওয়ার কথা ছিল। সেজন্য গত বছর এই দিনে (২৭ ফেব্রুয়ারি) নিমো বাসা থেকে তার খালার বাসায় যায়। ঘটনার সময়ও ওদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমাকে বলেছে, পিৎজা খাওয়া শেষ। আইসক্রিম খেয়ে বেরিয়ে যাবে। হঠাৎ আগুন লাগলে আমাদের জানায়। তাৎক্ষণিক আমরা সেখানে ছুটে গেছি। কিছুক্ষণ পর ওরা ওপরে উঠে যায়। আগুন সেখানে পৌঁছে, তাদের জীবন কেড়ে নেয়। সামান্য সময়ের ব্যবধানে আমার পরিবারের ছয় জনকে হারিয়েছি। আর কারও সঙ্গে এমনটা না হোক।’
মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে টাকা হলে সবই ম্যানেজ হয়ে যায়। এসব ঘটনায় কারও কখনও শাস্তি হয় না।’
আক্ষেপ করে তিনি বললেন, ‘এটা কী রাষ্ট্র নাকি! অবহেলা-অনিয়ম এসব দেখার কেউ আছে? সেজন্য এখন আর আশাও রাখি না।’
বেইলি রোডে আরেক নিহতের নাম আফরিন জাহান রিয়া। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই আফরিনের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বাবা কুরবান আলী সেটি গত বছরই বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর মেয়েটিকে হারান। এরপর গত ১ বছরে মেয়ের স্মৃতি সংরক্ষণে গড়েছেন জান্নাত ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের অধীনে ইসলামি শিক্ষার প্রসার ও মেয়ের আত্মার শান্তি কামনায় তিনি ‘আফরিন জাহান একাডেমি’ গড়ে তুলেছেন।
অন্যদিকে, মামলার আসামিপক্ষে আইনজীবী অভিজিৎ কর্মকার বলেন, ‘সঠিক তদন্ত হলে আমার মক্কেল নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। তার সঙ্গে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের কোনও সম্পর্ক নেই। ডিবি জিজ্ঞাসাবাদ করেও তেমন কিছু পায়নি।’