‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়’

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনও না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। তবে পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আরও খারাপ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হার ৮৭ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে ৭৬ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিক্যাল কলেজে ৫৪ শতাংশ।

রবিবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ব্লাস্ট আয়োজিত ‘যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নিদের্শনা: বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এসব জানিয়েছেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য তাহমিনা রহমান।

সভায় মূল প্রবন্ধের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ ছাত্রী। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫০ শতাংশের বেশি নারী অনলাইনে সহিংসতার শিকার হন।

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালত ১১ দফা নির্দেশনা দিলেও তার কার্যকরী বাস্তবায়ন নেই জানিয়ে জরিপে বলা হয়, ইউজিসি অনুমোদিত ১৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টি (৬১%) বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে। যার মধ্যে সরকারি ৪০টি ও বেসরকারি ৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। ৬২টি (৩৯%) বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেনি। গবেষণায় ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি প্রসঙ্গে তথ্য দিয়েছে বলে জানান তাহমিনা।

অভিযোগ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে যৌন হয়রানি ও উচ্চ আদালতের ১১ দফা নির্দেশনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানান তাহমিনা তিনি। ৭৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানেনি বলেও জানান তাহমিনা।

তিনি বলেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নির্দেশে রেজিস্টার তাদের পছন্দমতো সদস্য নির্বাচন করে অভিযোগ কমিটি গঠন করেন। এ বিষয়ে কাজের যোগ্যতা ও আগ্রহ বিবেচনা করা হয় না।

এ সময় তাহমিনা রহমান সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সচেতনতা, সুনির্দিষ্ট একটি আইন এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সিন্ডিকেট সভায় ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত, উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতি জোর দেন।

প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দেওয়া হয় জানিয়ে সভায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, আমাদের মধ্যে অভিযোগ না করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। আমরা সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোরও দায় আছে। কমিটিগুলোকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, খুব কম মেয়ে আছে যারা যৌন হয়রানির শিকার হয়নি। দেশে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, যৌন সহিংসতায় ভুক্তভোগী নারীর সম্মানহানির ভয়, বিচারহীনতার কারণে হাইকোর্টের নির্দেশনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। যৌন সহিংসতার ঘটনায় ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকারনামায় যৌন হয়রানি নিরসনের বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্তিকরণের দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আইনুন নাহার সিদ্দিকা বলেন, ১৫ বছরেও সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে কমিটি করা যায়নি। এটা স্পষ্ট আদালত অবমাননা এবং আইনকে অবজ্ঞা করার সামিল। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতেই এতদিন কোনও কমিটি ছিল না।

সভাপতির বক্তব্যে ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, অবন্তিকার ঘটনা একটা ব্রেকথু। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত নিয়োগের দৌরাত্ম্য হ্রাস করতে হবে। ডিসি, এসপিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানের ওপর তো আর কোনও আইন নেই। দল নিরপেক্ষ স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে যৌন হয়রানি মোকাবিলা করতে হবে।