সুপেয় পানির সংকট: ভুক্তভোগী নারীদের যত ভয়

ভেবে দেখেছেন কখনও এই সময়ে এসে পানির জন্য হাহাকার হয়। ঠিক চলচ্চিত্রের মতো, সারি বেঁধে মেয়েরা পানি আনতে যান আবাসস্থল দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। এই পানি আনাটা এতটাই কষ্টসাধ্য যে, মেয়েরা নিজেদের পানি খাওয়া পর্যন্ত কমিয়ে দেয়—যাতে দুই বারের জায়গায় একদিনে তিন বার পানি আনতে না যেতে হয়। সেই নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে যতটা শোনা যায়— তাদের এই পানি আনা-নেওয়ার সময়ে যেসব হয়রানি, তা কখনও প্রকাশ্যে আসে না। আড়ালে থাকা তাদের কথাগুলো শোনা যায় না বলেই যখন দেখা যায়— কেবল নারী বলেই পানি আনার দায়িত্ব তার ওপর বর্তায় বটে, কিন্তু পানি সংগ্রহে যাওয়া ২৫ শতাংশ নারীই পথে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

যারা সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নিয়ে কাজ করেন তারা বলছেন— জেন্ডার চিন্তা থেকে এই কাজগুলো বিবেচনা করার চল খুব বেশি দিনের না। এবার সময় এসেছে নারীকে সেই জায়গাটুকু করে দেওয়ার। কেবল প্রান্তিকভাবে এ ঘটনা ঘটে থাকে বলেই নারী অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হন। তারা অধিকারের বিষয়ে আওয়াজ দেন না, এটা তার সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।

নানান বাধার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সুপেয় পানি সংগ্রহ করা নারীদের একজন রমিজান। তিনি বলেন, ‘আমি দেড় কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনি। ওখানে একটা স্বাদু পানির পুকুর আছে। পুকুরের পানিই ভরসা। কিন্তু আবার সবসময় যেতেও পারি না। সাধারণত সন্ধ্যার বেশ পরে পানি আনতে যাই। কারণ, দিনের বেলায় অনেক ভিড়। তখন পুরুষরা নানা কাজের জন্য ওই পুকুরে পানি নিতে যায়। ওই সময় অনেক রকমের ঘটনা ঘটে।’  

এই পানি আমাদের কান্না হয়ে ঝরে উল্লেখ করে রাশিদা বলেন, ‘পানি বয়ে আনা কি যে কঠিন কাজ এটা কেউ বুঝে না। সেটা এক-দুই দিনের ব্যাপার হলেও হয়। রোজ কাজটি নিরলসভাবে করে যেতে হবে আমাদের। পানি ছাড়া কি কোন কাজ হয়? এখন তাও চাইলে আমরা অনেকে মিলে ভ্যান ভাড়া করে ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু কেবল মেয়ে বলেই কত রকম হয়রানি হয়।’

এক মা তার দুই সন্তানকে বাসায় রেখে পানি আনতে যান। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। এ সময় তার সন্তানেরা ঘরেই থাকে। কিন্তু তাদের দেখে রাখার কেউ থাকে না। পুরো যাওয়া-আসার সময়টুকু রোজ তিনি ভয় পেতে থাকেন তার দুই সন্তানকে নিয়ে। তারা ঘর থেকে বের হয়ে যদি রাস্তায় চলে যায়, সেটা দেখার কেউ নেই। আবার পানি ঠিক সময়ে না আনলে এই সন্তানদেরই পাতে ভাত জুটবে না। সব মিলিয়ে যে মানসিক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়, সেটা তিনি কার সঙ্গে শেয়ার করবেন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, জেন্ডার অসমতার জায়গাগুলো প্রকট হলেও সেসব চিহ্নিত করার প্রবণতা নেই বললেই চলে।

যেসব চ্যালেঞ্জ ও বাধার মুখোমুখি হতে হয়

ওয়াটার এইডের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, পানি সংগ্রহস্থলের অসমতার বিষয়ে কথা বলছেন ৩৬ শতাংশ নারী, প্রতিবন্ধকতার শিকার ২৪ শতাংশ ব্যক্তি পানি আনতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন, দূরে পানি আনতে গিয়ে স্কুল কামাই হয় ১৬ শতাংশের, আবার এদের কেউ কেউ স্কুল ছাড়তেও বাধ্য হন। পানি আনতে গিয়ে অন্য কাজের সময় পান না ২৪ শতাংশ নারী, আর পানি আনার পথে নিরাপত্তহীনতায় ২৫ শতাংশ নারী।

ঢাকায় সুইডেন দূতাবাসের আর্থিক সহযোগিতায় ওয়াটার এইড বাংলাদেশের ‘ওয়াশ ফর আরবান পুওর প্রকল্পের’ আওতায় দেশের চারটি সিটি করপোরেশন ও তিনটি পৌরসভায় নিম্নআয়ের সম্প্রদায়ের ৫৫০টি পরিবারের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সিটি করপোরেশনের মধ্যে রয়েছে— ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ও খুলনা সিটি করপোরেশন। তিনটি পৌরসভা হচ্ছে— নীলফামারীর সৈয়দপুর, টাঙ্গাইলের সখীপুর ও খুলনার পাইকগাছা। গবেষণায় পাওয়া উপাত্তে দেখা গেছে, গতানুগতিক জেন্ডার ভূমিকার কারণে নারীদের ওপর পরিবারের কাজ ও পানি সংগ্রহ করার দায়িত্ব চলে আসে। ৮৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, গৃহস্থালির কাজ ও পানি সংগ্রহ করা নারীদের কর্তব্য।

জেন্ডার সমতা-অসমতার বিষয়গুলো আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে উল্লেখ করে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, ‘কেবল কোনও একটি লৈঙ্গিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে যখন ব্যক্তিকে বিচার করা হয়, বা তার কাজ নির্ধারণ করা হয়, তখন সেটি তার জন্য অসম পরিবেশ সৃষ্টি করে। নারীদের উন্নতি ও জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়।’

তিনি বলেন, এটা এমন না যে, কোনও একটি কাজ গবেষণা বা জরিপের মধ্য দিয়ে হয়ে যাবে। এটি ধারাবাহিকভাবে করে যাওয়া একটি প্রক্রিয়া। আমাদের পরিবার, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানে  এক কথায় সব পর্যায়ে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।’