অফিসে কাজ শেষে করে ধানমন্ডি থেকে বান্ধবীকে নিয়ে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরছিলেন সুলতানা জাহান সুমি। রাত ১০টায় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের পাশে আসতেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তারা। দুটি মোটরসাইকেলে করে আসা ছিনতাইকারীরা তার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ওই নারী সড়কে পড়ে গুরুতর আহত হন।
এ ঘটনার পর ভুক্তভোগী নারী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পল্টন থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন।
জানতে চাইলে ভুক্তভোগী নারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত ৪ মে রাতে আমার বান্ধবীসহ রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের সামনে আসি। হঠাৎ মোটরসাকেল নিয়ে ছিনতাইকারী এসে আমার ব্যাগ টান দিলে আমি রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে যাই। পেছন দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে থামে। গাড়িটি না থামলে বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারতো। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে বেঁচে গেছি। কিন্তু আমার দুঃখ, পেছনে পল্টন থানা থাকার পরও এ ধরনের সাহস কীভাবে করতে পারে?
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার পর থেকে একটি ট্রমার মধ্যে আছি আমি। এ বিষয়ে পল্টন থানায় লিখিত অভিযোগ করেছি। তারা চাইলে চক্রটিকে ধরতে পারে। আজ আমি বেঁচে গেলাম, কাল যে আরেকজন তাদের হাতে মরবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে?
জানতে চাইলে অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর কবির বলেন, আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বিশ্লেষণ করছি। ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। এ জায়গায় গত রোজার ঈদেও এমন আরও ঘটনা ঘটেছে। আমরা তখন মোটরসাইকেলসহ ছিনতাইকারীদের আটক করেছি। এবার ছিনতাকারীরা পার পাবে না, ধরা পড়বেই।
৮ মে মোহাম্মদপুরে নবোদয় হাউজিং এলাকায় দিন দুপুরে আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে খাবার সরবরাহ করার জন্য এলাকার ৩ নম্বর সড়ক দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন জহিরুল ইসলাম। দুই ছিনতাইকারী তাকে পেছন থেকে ডেকে থামায়। পরে চাপাতি বের করে কোপ দিয়ে মোবাইল ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। ওই সময় আশপাশে থাকা লোকজনও ভয়ে পালিয়ে যায়। পরে পাশের একটি ফার্মেসিতে গিয়ে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী জহিরুল ইসলাম রাতেই বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মেহেদী (২০) ও রুহুল আমিন (২১) নামে দুই ছিনতাইকারী আটক করে পুলিশ।
শুধু মোবাইল-ব্যাগ নয়, রাজধানীতে এখন ছিনতাইকারীরা যাত্রীবেশে রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশাও ছিনিয়ে নিচ্ছে। গত ৮ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে আপ-ডাউন যাতায়াতের কথা বলে চালক শাহ আলম মিয়ার রিকশা ভাড়া করে দুই ব্যক্তি। পরে মাঝপথে কৌশলে তার রিকশাটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মামলা করলে তদন্তে নামে পুলিশ। অভিযানের পর চক্রটির খোঁজ পায় তারা।
পুলিশ জানায়, অটোরিকশা ছিনতাই চক্রের মূল হোতা শরীফুল ইসলাম। সে পেশায় কাভার্ড ভ্যানচালক। ৯ মাস আগে সে যে কাভার্ড ভ্যান ভাড়ায় চালাতো, মালিক সেটি বিক্রি করে দিলে সে বেকার হয়ে যায়। পরে একজনের কাছে অটোরিকশা চুরি শেখে। এই চক্রে তারা তিন সদস্য। প্রতি সপ্তাহে অন্তত চারটি রিকশা ছিনতাই করতো তারা। এরই ধারাবাহিকতায় গত এপ্রিল রাত ৯টার দিকে রামপুরা থানার বনশ্রী এলাকায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শাহ আলমের রিকশা ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে শাহ আলমকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে স্বজনরা মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ এপ্রিল মারা যান তিনি।
এ ঘটনায় মামলা হলে গত ৪ মে চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে রামপুরা থানা পুলিশ। চক্রটি গত ৯ মাসে শতাধিক রিকশা চুরি করেছে বলে জানায় পুলিশ।
ছিনতাইকারীদের উৎপাত কমবেশি সারা বছরই ঘটছে। তবে দুই ঈদের সময় রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা।
গত বছর ঢাকা মহানগরকে ছিনতাইমুক্ত করতে এবং নগরবাসীর নিরাপত্তা ও চলাচল নির্বিঘ্ন করতে টাস্কফোর্স গঠন করে ডিএমপি। ১৯ সদস্যবিশিষ্ট এই টাস্কফোর্স রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের বিভিন্ন হটস্পট শনাক্ত করে। ছিনতাই দমনে চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় অভিযান। গ্রেফতার করা হয় শত শত ছিনতাইকারীকে। তবু উৎপাত কমছে না তাদের।
আর কদিন পরই জমে উঠবে কোরবানির পশুর হাট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এবার ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ব্যবসায়ীরা যাতে গরুর হাটে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারেন, পশু কেনাবেচা করতে পারেন, এ জন্য সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অপরাধীদের ধরতে পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে। গতকাল কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে চোরাই রিকশা কেনার সঙ্গে জড়িত একটি গ্রুপের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। ছিনতাই নিয়ে কোনও অভিযোগ এলে সেগুলোর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এত অভিযানের পরও কেন ছিনতাকারীদের দমন করা যাচ্ছে না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দমন হচ্ছে না, সেটা বলা যাবে না। তবে পুরোপুরি দমন হচ্ছে না। অপরাধীদের ধরতে আমাদের চেষ্টার কোনও কমতি নেই। কোরবানি ঈদে গরুর হাটে নিরাপত্তা নিয়ে মিটিং করা হচ্ছে। রিকশাচালকতের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, অচেনা যাত্রীদের কাছ থেকে কিছু না খাওয়া ভালো। খেলেই আপনাদের গাড়ি লুট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছিনতাইয়ের সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ ওই এলাকার ব্যাটালিয়নের কাছে করলে তারা ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া অন্যান্যবারের মতো এবারও কোরবানির পশুর হাটে নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকবে। প্রতিটি হাটে আমাদের সাপোর্ট সেন্টার থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছিনতাই দমন করা কঠিন কিছু নয়, যদি সেভাবে কাজ করা হয়। ছিনতাই রোধ করার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ যে টাস্কফোর্স গঠন করেছে, সে জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। তবে শুধু টাস্কফোর্স গঠন করলে হবে না, মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ছিনতাইয়ের হটস্পট এলাকার থানা পুলিশকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আমরা দেখেছি ছিনতাইকারীদের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত। এ ছাড়া অনেকে ছিনতাইকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ঢুকে জামিনে বের হয়ে আবার ছিনতাই শুরু করছে। ছিনতাই দমনে যে আইন রয়েছে, সেই আইনের সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করি। এ ছাড়া ছিনতাইকারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে ছিনতাই কমে আসবে।