খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?

কিছু উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ঠিক করলো— একটা হলেও আশপাশের কোনও একটা খাল তারা পরিষ্কার করবে। তাদের স্পিরিটা ছিল অনেকটা এ রকম— সব কি সরকার করবে, আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। যে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পরিষ্কারের কাজে নেমেছিল তারা, খাল থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্র দেখে ঠিক তেমনই লজ্জায় মাথা নত হলো। এই যে বাসার পাশের পানির উৎসটি নোংরা- আবর্জনায়  ভরা, এসব তো আমাদেরই ফেলা। ঘরের সোফা বা ফোম নষ্ট হয়েছে, পাশের খালে ফেলে দিলাম। ছোট ফ্রিজে আর বাসায় হচ্ছে না, বড় ফ্রিজ কিনে ছোটটা কী করবো, ফেলে দিলাম খালে। ছেলে দুই বছরের পর আর পটি ব্যবহার করে না, সেটাতো খালের পানিতে ফেলা ভালো, দেখা যাবে না!

এই যে ঘরের বাতিল হওয়া জিনিস ফেলে ফেলে খাল-ড্রেন সব বন্ধ করা হচ্ছে, তেমনই একটা খাল পরীক্ষামূলক পরিষ্কার করা হলো। ঘটনাটি গত বছরের (২০২৩)। সেই খাল এখন কেমন আছে? সেই খালটি এখন আবারও ভরতে যাচ্ছে আমাদেরই ফেলা নষ্ট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন জিনিসে।

মোহাম্মদপুর লিমিটেড ২ নম্বর ব্রিজ এলাকার খাল, ২০২২ সালের অবস্থা (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

সরেজমিনে দেখা যায়, যে-ই খালের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, সে-ই হাতে থাকা কিছু না কিছু ফেলে যাচ্ছে। পাশের ভবনের তিন তলা থেকে চিপসের প্যাকেট পড়লো, ক্ষয়ে যাওয়া ফুলঝাড়ুও পড়লো। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, এগুলো পানির নিচে চলে যাবে, ঝাড়ু পচে যাবে, ফেললে কী সমস্যা। এই যে সমস্যাটাই ধরতে না পারা, সেই দায়ে ধুঁকছে ঢাকার নিশ্বাসের অন্যতম আধার খালগুলো।

মোহাম্মদপুর সোসাইটি লিমিটেড এলাকার খালের বর্তমান অবস্থা (বাঁয়ে) ও আগের অবস্থা (ডানে)ঢাকার মোহাম্মদপুর লিমিটেড এলাকার ৩ নম্বর ব্রিজের কাছে বস্তা ভরে বাসার বর্জ্য খালের পাশে ফেলে যাচ্ছিলেন পাশের এক বাসার কেয়ারটেকার। এই ময়লা কেন ফেলছেন খালে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ির ভাড়াটিয়া বদল হয়েছে। তারা বেশকিছু ময়লা ফেলে রেখে চলে গেছে। ফ্ল্যাট পরিষ্কার করে সেগুলো গুছিয়ে ফেলে দিতে এসেছেন তিনি। সেটা খালে ফেলছেন কেন প্রশ্ন করা হলে হেসে বলেন, এখানে ধীরে ধীরে মিশে যাবে।

২০২০ সালে ফিরে যাই। রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর এলাকার ‘গোদাগাড়ি খাল’ পরিষ্কারে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে অংশ নেন ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। খাল থেকে উঠে আসা জিনিস দেখে সেসময় সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। কী ছিল না সেই তালিকায়— নষ্ট ফ্রিজ, টেলিভিশন, বাথরুমের কমোড, স্যুটকেস, স্কুল ব্যাগ, গাড়ির টায়ার, বালিশ, সোফা, জাজিম, তোষক, চেয়ার ও বড় পানির বোতল।

মোহাম্মদপুর লিমিটেড ২ নম্বর ব্রিজ এলাকার খাল, ছবি: সাজ্জাদ হোসেন একটি শহরে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ প্রাকৃতিক জলাধার থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় বাস্তবে তা আছে ৪ শতাংশেরও কম। সেটাও নষ্ট করে রাখি আমরাই। যে জলাশয়গুলো রয়েছে, তার প্রায় বেশিরভাগ দূষণ-দখলে মৃতপ্রায়। তরুণদের নিয়ে খাল পরিষ্কার করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার শিকার মোর্শেদ মিশু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটু বৃষ্টি হলেই আমাদের প্রিয় শহরটা ডুবে যায়। এ শহরে বাঁচি আমরা, নিশ্বাসটাও আমরাই নিই। তাহলে এটাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে নাগরিক হিসেবে আমাদের যা করণীয়, সেটা আমরা করি কিনা— নিজেদেরকে সেই প্রশ্ন করার সময় এসেছে। আমরা ফেসবুকে খাল পরিষ্কারের ডাক দিয়ে কাজটি করে দেখিয়েছিলাম। তার মানে এই কাজটি যে জরুরি, সেই বোধসম্পন্ন মানুষ আছেন। এখন দরকার নিয়মিত সচেতনতা তৈরির কাজ।’

জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে খাল, ড্রেন ও অন্যত্র ফেলে দেওয়া বর্জ্য নিয়ে ১১ মে প্রদর্শনীর আয়োজন করে ডিএনসিসি। সেদিন মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘নগরবাসীকে দেখাতে চাই, তারা কী ধরনের বর্জ্য খালের ভেতরে ফেলছে।’

মোহাম্মদপুর লিমিটেড ২ নম্বর ব্রিজ এলাকার খাল, ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এই খালগুলো ময়লা ফেলে ভরাট করে দিয়ে নিজেদেরই যে ক্ষতি করছি, এটা একবারও ভাবি না। কী ফেলছি এটা দেখানোর জন্য আমি প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করেছি। মানুষ বুঝুক তারও কিছু নাগরিক দায়িত্ব আছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে, সবাই যখন শুধু নিজের চিন্তা করে। আমার বাসাটা শুধু বাসযোগ্য করলে হবে না, পুরো শহরটার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। সেটিও তারা একদিন অনুধাবন করবেন।’

আরও পড়ুন- 

কল্যাণপুরে হবে ‘হাইড্রো ইকোপার্ক’, কমবে জলাবদ্ধতা বাড়বে সৌন্দর্য

সুতিভোলা খাল উদ্ধারে তৎপর ডিএনসিসি, ‘বাধা’ স্থানীয়রা

সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিনোদন পার্ক করবে ডিএনসিসি