রামচন্দ্রপুর খালের বিলীন যে অংশের চিহ্ন রয়ে গেছে এখনও

এক সময় বাধাহীন স্রোত বইতো রাজধানীর রামচন্দ্রপুর খালে। সাত মসজিদ হাউজিং এলাকা থেকে শুরু হয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরের পশ্চিম কাটাসুরির মধ্য দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল খালটি। আরেকটি অংশ রায়েরবাজার বদ্ধভূমির পেছন ঘুরে বসিলা এলাকার ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিং দিয়ে একই নদীতে যুক্ত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খালটি সরু হয়েছে, কোথাও কোথাও বালি ফেলে ভরাট করা হয়েছে, কিংবা কোথাও তৈরি হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। অনেক জায়গায় স্থানীয়দের ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে খালটির কয়েকটি অংশ এখন মৃতপ্রায়। যে খালে ঢেউ ছিল সেখানে আর থই থই পানি নেই, পরিণত হয়েছে ময়লার স্তূপে। বিশেষ করে রামচন্দ্রপুর খালের উত্তরমুখি একটি শাখা এখন বিলীন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসা থেকে রামচন্দ্রপুরসহ নিজেদের এলাকার আওতাধীন সবগুলো খালের দ্বায়িত্ব বুঝে নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এরপর থেকেই রামচন্দ্রপুর খাল উদ্ধারে মনোযোগী হয় ডিএনসিসি।

ইউল্যাবের সীমানা ঘেঁষে রামচন্দ্রপুর খালের বিলীন অংশের রয়ে যাওয়া চিহ্ন

খালপাড়ে বেশ কিছুদিন ধরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ সীমানা নির্ধারণে পিলার বসানোর কাজ চলছে। এছাড়াও চলছে খালের ভরাট অংশ পুনরায় খননের কাজ। সম্প্রতি সাত মসজিদ হাউজিং অংশে খালের ওপর অবৈধ জমি ভাড়া নিয়ে গড়ে ওঠা আলোচিত সাদিক এগ্রোর পশুর খামারটি উচ্ছেদ করা হয়। তাই আবারও আলোচনায় আসে রামচন্দ্রপুর খাল।

শুধু পশুর খামার নয়, খাল দখল করে গড়ে ওঠা বস্তি, রিকশার গ্যারেজ ও স্থানীয় রাজনৈতিক কার্যালয়ও উচ্ছেদ করা হয়। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা আশা করছেন খালটির আগের রূপ ফিরে আসবে দ্রুত।

তবে বাস্তবতা হলো, খালের উত্তর অংশটি এখন নিশ্চিহ্ন। এখানে যে একটি খাল ছিল সেটি বুঝতে হলে প্রবেশ করতে হবে রামচন্দ্রপুরে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নিশ্চিহ্নপ্রায় খালের কিছু অংশ নিরবে টিকে আছে ইউল্যাবের ভেতরে   

এক সময় রামচন্দ্রপুর খালের একটি অংশ অনেকদূর বয়ে গিয়েছিল রাজধানীর উত্তর দিক দিয়ে। তবে বর্তমানে বোঝার উপায় নেই এই দিক দিয়ে খালের একটি গতিপথ ছিল। সরকারি রাস্তা, আবাসন প্রকল্প ও স্থানীয়দের অবৈধ দখলের কারণে খালের ওই অংশটি এখন নিশ্চিহ্ন।

উত্তর অংশ দিয়ে যে রামচন্দ্রপুরের একটি শাখা বয়ে গিয়েছিল, সেটি বুঝতে হলে যেতে হবে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের পাশে, যেখানে এখনও রামচন্দ্রপুরের উত্তর অংশের একটি টুকরো টিকে আছে সযতনে।

রামচন্দ্রপুর খালের বিলীন অংশের রয়ে যাওয়া চিহ্ন যেটা সযতনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখছে ইউল্যাব কর্তৃপক্ষ

দুপাড় বাঁধাই করা ও পানি পরিষ্কার রাখা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যলয় কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায়। এছাড়া টিকে থাকা খালের অবৈধ দখল ঠেকাতেও নিজ উদ্যোগে একটি সীমানা দেয়াল দেওয়া হয়েছে। অথচ এই সীমানা ঘেঁষে বাইরের অংশে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাসাবাড়ি ও দোকানপাট যাদের নেই কোনও প্লট নম্বরও। আর এই সীমানা দেয়াল থাকায় দখলদারদের দখলদারত্ব আটকে গেছে অল্প কিছু জায়গায়।

স্থানীয় ও দখলদারদের বক্তব্য, এই সীমানা দেয়াল থাকায় খালের হারিয়ে যাওয়া কিছু অংশ এখনও টিকে আছে। তা না হলে ধীরে ধীরে টিকে থাকা খালের অবশিষ্ট অংশও বিলীন হয়ে যেত।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খাল রক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া সীমানা দেয়াল ঘেঁষে পাঁচটি রুম তুলে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন মোহম্মদ রফিক। তিনি এখানে থাকেন না। নবীনগর হাউজিংয়ে অবস্থিত একটি বাড়ি দেখাশোনা করেন। দীর্ঘদিন একই এলাকার থাকার সুবাদে প্রায় ১০ বছর আগে খালের পাড়ে বালি ফেলে ভরাট করে ফেলেন বেশ কিছু জায়গা। ৫ বছর আগে এখানে পাকা ঘর তোলেন।

ভরাট হয়ে যাওয়া জায়গায় উঠছে দোকানপাট

ঘর তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িটি খালের জায়গার ওপর। খাল উত্তর পাশ দিয়ে অনেকদূর গিয়েছিল। পরে এই খাল ধীরে ধীরে ভরাট করেছে অনেকেই। এই যে হাউজিংয়ের ভেতরে যাওয়ার রাস্তাটারও অনেক অংশ এই খালের জায়গা ভরাট করে করা হয়েছে। তাই আমিও মীনা বাজারের কোণা দিয়ে বালি ভরাট করেছি। প্রায় ৪০ কাঠার মতো জায়গা বিভিন্ন জনের দখলে আছে, যেটা আসলে সরকারের। আমারটা সরকার চাইলেই আমি ছেড়ে দেবো।’

তিনি বলেন, ‘আগে তো এখানে মীনা বাজারের গোডাউন ছিল, পরে খালের আরেক পাশে ইউনিভার্সিটি হয়েছে। তখন এই দেয়াল তোলা হয়। এই দেয়ালের কারণে অনেকেই আর খাল ভরাট করতে পারেনি। যারা আগে পেরেছে তারাই ঘর-দোকান এসব তুলছে।’

একই তথ্য জানিয়েছেন নবীনগর হাউজিংয়ে বসবাস করা প্রায় ৬০ বছর বয়সী দুলাল মিয়া। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনটা খাল আর কোনটা দখলের তা আমি ঠিক বলতে পারবো না। সরকার ম্যাপ ধরে টান দিলে অনেক খাস জমি পাবে যেইখানে এখন অনেক বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে। তবে এখান দিয়ে খালের মতো একটা ছিল যার একটা অংশ এখন মীনা বাজারের (ইউল্যাব না বলে স্থানীয়রা অনেকেই এই অংশটি বলেন মীনা বাজার) সীমানার ভেতর গেলে দেখা যাবে। ওইখানে এখনও খালের কিছু অংশ ঠিক আছে।’

খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে যাদের প্লট নম্বর নেই

এদিকে রামচন্দ্রপুর খালের উত্তর পাশের শাখার যে অংশটি টিকে আছে তা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় প্রায় ৬০ ফুটের মতো চওড়া একটি খালের ছোট অংশ এখনও দৃশ্যমান। এই ছোট অংশটির উত্তর দিকের শেষ মাথায় একটি সীমানা দেয়াল রয়েছে। সেই দেয়ালের পেছনেই কিছু অবৈধ প্লট, বাড়ি ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এর পরেই নবীনগর হাউজিং এ প্রবেশের একটি সড়ক যা এখন সরকারি। সড়কটি শুধু নবীনগর হাউজিং নয়, মোহম্মদীয়া, চন্দ্রিমা, ঢাকা উদ্যানসহ আরও কয়েকটি হাউজিংয়ের মানুষজন নিয়মিত চলাচল করেন।

তবে টিকে থাকা খালটির পূর্ব-দক্ষিণ অংশ এখনও বিভিন্ন কারণে ভরাট। সরকারের পক্ষ থেকেও এই অংশ থেকে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফলে এখানে আর পানির প্রবাহ নেই। এছাড়া এই অংশে একটি গরুর খামার ছিল, সেখানকার নানা বর্জ্য ইউল্যাবের সুরক্ষিত খালে এসে পড়ে খালের পানি নষ্ট হয়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই অস্থায়ীভাবে বাঁধ দেয় ইউল্যাব কর্তৃপক্ষ, তা করা না হলে পাশের ময়লা আবর্জনা এসে খালের টিকে থাকা অংশটিকেও নোংরা করে দিত। অথচ এই খালের পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে প্রথমে নিচে দিয়ে বড় সুয়ারেজ পাইপ বসানো হয়েছিল এবং খালের ওপর দিয়ে যাতায়াতের জন্য স্টিলের একটি ব্রিজ বানানো হয়েছিলো বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

খালের শেষ অংশে সীমানা দেয়াল দেওয়া এবং খালের ওপর দিয়ে রাস্তা নেওয়ার বিষয়ে ইউল্যাব কর্তৃপক্ষ বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, উত্তর পাশ দিয়ে রামচন্দ্রপুর খালের যে অংশটি গিয়েছিল তা ধীরে ধীরে স্থানীয়দের দ্বারা ভরাট হয়ে আসছিল। অথচ এই খালের দুই পাশে বিশ্ববিদ্যালয় ও মীনা বাজারের নিজেস্ব জায়গা রয়েছে। এই দুটি জায়গার মাঝ দিয়ে অবৈধ বসতি ও স্থাপনা গড়ে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয় ও মীনা বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা ছিল। তাই নিজেদের সীমানা দেয়াল ওঠানোর সময় যে অংশ পর্যন্ত খালের উত্তর পাশ দখল হয়ে গিয়েছে, সেখান থেকেও নিজস্ব জমির দেয়ালের সঙ্গে আরেকটি দেয়াল উঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে করে দখলদাররা আর এগুতে না পারে। টিকে থাকা খালের অংশ নিয়মিত পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত রাখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগেই।

খালের পূর্ব অংশ ভরাট হওয়ায় পানির প্রবাহ নেই

এবিষয়ে ইউল্যাব-এর রেজিস্ট্রার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুল ইসলাম (অব.) বলেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রধান সড়ক পেরিয়ে খালের পশ্চিম পাশে পড়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে খালের ওপর একটি ব্রিজ দেওয়া জরুরি হয়ে গিয়েছিল। তবে নিচে বড় সুয়ারেজ পাইপ বসানো হয়েছিল যাতে পানির প্রবাহ ঠিক থাকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে খালের পূর্ব অংশটি নানা কারণে ভরাট হয়েছে। আর এ কারণেই উত্তর দিকে খালে পানির প্রবাহ নেই। এছাড়া এপাশে একটি গরুর খামার ছিল যা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই খামারের বর্জ্যগুলো এসে খালের পানি নষ্ট করতো। যেহেতু পানির প্রবাহ নেই এবং বর্জ্য এসে টিকিয়ে রাখা খালের পানি নষ্ট করছে, তাই অনেকটা বাধ্য হয়েছি অস্থায়ীভাবে একটি বাঁধ দিতে যা যেকোনও সময় অপসরণ করা যাবে।

এদিকে রামচন্দ্রপুর খালের যে অংশে ডিএনসিসি থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় সেই অংশে ইউল্যাবের কোনও দখল নেই বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ইউল্যাব নিজ সীমানায় গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে খালের সীমানা নির্ধারণ করে পিলার বসানো হয়েছে তার থেকে বেশ ভেতরেই ইউল্যাব। তবে খালের সংস্কারের যেকোনও প্রয়োজনে ইউল্যাব থেকে সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।

উদ্ধার হবে ডিএনসিসির সব খাল

খাল উদ্ধারে কোনও ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না বলে প্রায়ই জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। দ্বায়িত্বের শেষ বছরে খাল উদ্ধারের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলেও জানান তিনি। এরই মধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল ঘেঁষে গড়ে ওঠা নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন ভেঙে দিয়ে সেই বার্তায় দিয়েছেন মেয়র। সম্প্রতি আলোচিত সাদিক এগ্রোর খামারসহ অনান্য স্থাপনার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে খাল পাড় থেকে। 

বিভিন্ন সময় রামচন্দ্রপুর খাল উদ্ধার কার্যক্রম দেখতে এসে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, রামচন্দ্রপুর খাল আপনারা দেখেছেন দখল হয়ে গিয়েছিল, মাটি ফেলে ভরাট করে অবৈধ ট্রাক স্টান্ডও গড়ে তোলা হয়েছিলো। পরবর্তীতে তা উচ্ছেদ করে খনন করা হয়। এখন এটি সুন্দর সবুজ পার্ক হয়ে গিয়েছে।

মেয়র সম্প্রতি বলেন, যেখানে দখল হচ্ছে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে। মাঠ, পার্ক ও খাল যারা অবৈধভাবে দখল করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাঠ পার্ক ও খাল রেখে যেতে হবে। এটি আমাদের দায়িত্ব। ডিএনসিসি’র অধীনে থাকা খালগুলো উদ্ধার করে সুস্থ ও বসবাসযোগ্য ঢাকা গড়ার চেষ্টায় আছি।

স্থানীয় ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদও বলেন, মেয়রের নির্দেশনায় আমরা এগিয়ে যাবো। খালের ওপর কোনও ধরনের স্থাপনা রাখা যাবে না। যে অংশ হারিয়ে গিয়েছে তা চিহ্নিত করে উচ্ছেদ করা হবে। খালের পানির প্রবাহ আগের রূপে ফিরিয়ে আনা হবে।

আরও পড়ুন-

ময়লা সরালেও আবার আগের চেহারায় ফিরে যায় খাল

খালের সীমানা নির্ধারণে কতটা এগোলো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন?

খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?

কল্যাণপুরে হবে ‘হাইড্রো ইকোপার্ক’, কমবে জলাবদ্ধতা বাড়বে সৌন্দর্য

সুতিভোলা খাল উদ্ধারে তৎপর ডিএনসিসি, ‘বাধা’ স্থানীয়রা

সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিনোদন পার্ক করবে ডিএনসিসি