রাইড শেয়ারে বিশৃঙ্খলা, বাইকারের সংখ্যা ‘বেড়েছে’

যানজটের নগরী ঢাকায় অল্প সময়ের মধ্যে দূরের গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেকেরই পছন্দের বাহন মোটরসাইকেল বা বাইক। এই সুযোগে রাজধানীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাইড শেয়ারিং অ্যাপের ব্যবহার। কেউ কেউ পেশা হিসেবে বাইক চালাতে শুরু করেন, আবার অনেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ নিতে নিজস্ব পেশার পাশাপাশি নিজের বাইকে ভাড়ায় যাত্রী বহন করেন। কিন্তু হঠাৎ করে এই খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। বাইকচালকরা বলছেন, রাজধানীতে গত কয়েক মাসে ভাড়ায় চলা বাইকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এবং তারা অ্যাপের চেয়ে রাস্তা থেকে ডেকে ডেকে যাত্রী তুলতেই বেশি আগ্রহী। এসব চালকের কারণে রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা তৈরি হয়ে যানজটও বেড়েছে। যাত্রীরাও এই বাইকারদের কাছে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলছেন। 

বাইক রাইড শেয়ার চালকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়া ট্রাফিক ব্যবস্থার কারণেও সড়কে এখন কড়াকড়ি নেই। তাই অনেকেই এই সুযোগে বাইক নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমেছেন। জীবনযাপন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চাকরিজীবী অনেকে অফিস সময়ের বাইরে পার্টটাইম বাইক রাইড শেয়ারিং করছেন। তাই ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে এখন বাইকচালকের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। এতে যাত্রী পেতে যেমন দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে, তেমন প্রতিযোগিতার বাজারে রাইড শেয়ার সেবার মূল্যও কমাতে হচ্ছে।

যাত্রী ও বাইকচালক উভয়ের দিক থেকেই অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে অধিকাংশ চালকই অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ার করেন না। তারা চুক্তিভিত্তিক সেবা দেন। নতুন চালকদের বেশিরভাগ কোনও অ্যাপে নিবন্ধন নেননি। এছাড়া সড়কে পুলিশি কড়াকড়ি না থাকায় অনেকেই রেজিস্ট্রেশনবিহীন ত্রুটিপূর্ণ বাইক নিয়েও এই সেবা দিচ্ছেন। ট্রাফিক আইন অমান্য, দ্রুত চলার প্রবণতা থেকে ঘন ঘন ওভারটেকিং ও অতিরিক্ত হর্ন ব্যবহার, যাত্রীদের নিরাপত্তার নিশ্চিতে অবহেলা ইত্যাদি বিষয়েও অভিযোগ জানিয়েছেন যাত্রী ও অন্যান্য যানচালকরা।

চালকরা যা বলছেন

মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকচালক আবদুর রহিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাইডার অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে গত কোরবানির ঈদের পর এই সংখ্যা অনেকে বেড়ে গেছে। বলা চলে এখন ভাড়ায় দ্বিগুণ বাইক চলে। আগে কোনও মোড়ে ১০টা বাইক দাঁড়ানো থাকলে এখন সেখানে ৩০টা বা তার বেশিও দেখতে পাবেন। বছর খানেক আগেও দিনে অন্তত দুই হাজার টাকা আয় হতো। এখন হাজার ১২শ’ উঠাতেই কষ্ট হয়ে যায়।

৫ আগস্টের পর বাইকচালকের সংখ্যা বেড়েছে জানিয়ে কালশি মোড়ে ফয়সাল আহমেদ নামে আরেক চালক বলেন, ‘আন্দোলনের পর ট্রাফিক পুলিশ আর আগের মতো কড়াকড়ি করে না। মোড়গুলোয় দাঁড়ালে পুলিশ বাধা দেয় না। তাই এই সুযোগে অনেকেই কোনোমতে একটা বাইক নিয়া বাইক রাইড দিতে নাইমা পড়ছে। যারা চাকরি করে তারাও এখন রাইড দিতে নামছে।’

ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক বাইক এসেছে জানিয়ে কাওরান বাজার এলাকায় যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা বাইকচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি আগে মুন্সিগঞ্জে ছিলাম। ১ বছর আগে ঢাকায় এসেছি। দুই তিন মাস এরকম অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারাও ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন।

যাত্রী হারানোর অভিযোগ পেশাদারদের

কোনও অ্যাপে নিবন্ধন না করা চালক যেমন বেড়েছে, আবার অন্য পেশাজীবীরাও রাইড শেয়ারে ঝুঁকছেন বলে অভিযোগ পেশাদার রাইড চালকদের। চালক বাড়ায় ভাড়া কম নিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

কয়েকজন চালক বলেন, তাদের কেউ সঞ্চয় ভেঙে মোটরসাইকেল কিনে এই পেশায় এসেছেন। কেউ বা আগে সিএনজি বা বাস চালাতেন। কেউ আবার ব্যবসা বা চাকরি ছেড়ে এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তাই জীবনযাপনের সম্পূর্ণ নির্ভরতা এই পেশার ওপর। নিবন্ধনবিহীন খণ্ডকালীন বাইকচালকদের কারণে যাত্রী হারাতে হচ্ছে পেশাদার চালকদের।

শাহবাগে থাকা বাইকচালক মানিক মিয়া বলেন, ‘আমার আয় এইখান থেকেই। যারা চাকরি করে তাদের তো বাইক চালানো টাকার ওপর নির্ভর করতে হয় না। চলতি পথে কম বেশি যা ভাড়া পায় ওইটা নিয়েই যাত্রী টানে। এতে যাত্রী নষ্ট হয়। পরে ভাড়া বাড়াইতে চায় না।’

সকাল ও বিকালে যাত্রীর চাপ থাকে, তখন খণ্ডকালীন চালকদেরও উপস্থিতি বেশি হওয়ায় ভাড়া পড়ে যায়। এই অভিযোগ করে শাহবাগে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক চালক শিমুল বলেন, ‘সকাল-সন্ধ্যায় যাত্রীর চাহিদা থাকে। ওই সময় অফিস শেষ করে অনেক চাকরিজীবীই আসেন রাইড শেয়ার করতে। বাড়ি যাওয়ার পথে কমবেশি যা পায় যাত্রী নিয়া যায়। এতে আমাদের ক্ষতি।’

অ্যাপে বাইক রাইড শেয়ার না দেওয়া ‘বেআইনি’

রাজধানীতে বাইক রাইড শেয়ারিং পেশাটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিভিন্ন অ্যাপ কোম্পানির মাধ্যমে। অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং সঠিক সেবা দিতে বাইকচালকরাও দায়বদ্ধ থাকেন। তবে অ্যাপ কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত কমিশন আদায়ের অভিযোগে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে আসছেন বাইকচালকরা। এর মাঝেও ব্যতিক্রম কোনও কোনও বাইকচালক। তারা অ্যাপের মাধ্যমেই রাইড শেয়ারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

বাইকচালক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘কমিশন দিতে না চাওয়াটা একটা স্বার্থপরতা। আপনি আপনার আয়ের ভাগ কাউকে দেবেন না বলে নিজেকে ও যাত্রীকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। তাছাড়া চুক্তিভিত্তিক বাইক রাইডাররা যেনতেনভাবে সেবা দেয়। সামনে দিয়ে যাওয়া মানুষজনকে ডাকাডাকি করে। এটা আমার কাছে বিরক্ত লাগে।’

বাইকে যাত্রী বহনকে মূল পেশা হিসেবে নিচ্ছেন অনেকে (ছবি: প্রতিবেদক)

চুক্তিভিত্তিক বাইক রাইডারদের সহজে পাওয়া যায়, তাই তাদের ভাড়া করেন জানিয়ে মিরপুর ১০ থেকে ওঠা যাত্রী ইমরুল হাসান বলেন, অ্যাপে বাইক নিতে হলে ইন্টারনেট লাগে। আবার অনেক সময় বাসায় থেকেও বাইক পাওয়া যায় না। রাস্তায় এসেই যদি বাইক নিতে হয় তাহলে চুক্তিতে যাওয়াই ভালো। দামদর করা যায়।

জীবন ইসলাম নামের এক যাত্রী জানান, অ্যাপ ও চুক্তিভিত্তিক চালকদের দুরকম সুবিধা আছে। অ্যাপে রাইড নিলে ঝুঁকি কম, নিরাপত্তা বেশি; ঝামেলাহীনভাবে গন্তব্যে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকলে বা গতি কম থাকলে এটায় অসুবিধা। রাস্তায় থাকলে চুক্তিভিত্তিক রাইডে ওঠাই সহজ। এক্ষেত্রে কম ভাড়ায়ও চলে যাওয়া যায় গন্তব্যে। তবে কোন পথ দিয়ে যাবে, হেলমেট না থাকা, এসব নিয়ে ঝামেলা হয় কোনও কোনও সময়।

যা বলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে যে অ্যাপ ছাড়া যাত্রী নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা বেআইনি। তবে আমাদের দেশে যে কমিশনের পরিমাণ, সেটা উন্নত দেশের সঙ্গে মেলালে হবে না। চালকদের অ্যাপ ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলতে হলে কমিশন ব্যবস্থা গতিশীল করতে হবে। পিক আওয়ারে কমিশন কমিয়ে দিতে হবে, অফপিক আওয়ারে না হয় ১৫ শতাংশ কমিশন রাখতে পারে কোম্পানিগুলো।

যাত্রীদেরও এক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ যখন অ্যাপে রাইড শেয়ার দেয় তখন তার ড্রাইভিং লাইসেন্স, ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও বাইকের রেজিস্ট্রেশনের কপি জমা থাকে। সেক্ষেত্রে বলা যায় এসব চালক দক্ষ। যাত্রীরা যদি অ্যাপে বাইক রাইড নেন তাহলে তারাও নিজেরাও নিরাপদ থাকবেন।

ট্রাফিক পুলিশের বড় ভূমিকা রয়েছে অ্যাপবিহীন রাইড শেয়ার বন্ধে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি গাড়ি যখন অ্যাপে নিবন্ধন হয় সেই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বরও দেওয়া থাকে। বর্তমানে আমাদের প্রত্যেকটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্লেটে আরএফআইডি (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) ট্যাগ থাকে। পেশাদার কেউ যদি অ্যাপে যাত্রী বহন না করে তাহলে সেই ট্যাগ দেখেই মামলা দেওয়া সম্ভব। এর জন্য গাড়ি থামাতে হয় না।

যা বলছে ট্রাফিক পুলিশ

রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক সার্জেন্টদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সরকার পতনের পর ট্রাফিক ব্যবস্থা নাজুক হলে সড়কে নানা ইস্যু তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি চেষ্টা করা হচ্ছে সব কিছু স্বাভাবিক করতে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন বাইক ও অন্যান্য যানের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ট্রাফিক শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক বিভাগের অভিযান চলমান আছে। যারা ট্রাফিক আইন অমান্য করছে এবং সড়কে যেখানে সেখানে পার্কিং ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সড়কে বাস ও মোটরসাইকেল চালকরাই বেশি আইন ভঙ্গ করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।