গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল বৈষম্যমুক্ত সর্বজনের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা। জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি নারীদের বাদ দিয়ে যা কখনোই সম্ভব না। শুধু পুরুষদের জন্য না, নারীদের উপস্থিতি থাকাতেই এই আন্দোলন সফল হয়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র যদি একটি বিশেষ লিঙ্গের, বিশেষ শ্রেণির, বিশেষ জাতি-ধর্ম পরিচয়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে ওঠে, তবে তা হবে শহীদ ও আহতদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি।
শুক্রবার (২২ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অডিটোরিয়ামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লড়াকু ২৪ এবং এমপাওয়ারিং আওয়ার ফাইটার্স আয়োজিত 'নারীরা কোথায় গেলো?' শীর্ষক গণঅভ্যুত্থানের নারীদের নিয়ে সংলাপ অনুষ্ঠানে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নারীরা এসব কথা বলেন।
সংলাপে বক্তারা বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশের সর্বস্তরের নারীদের অভূতপূর্ব উপস্থিতি ছিল। নারীরা এ সময় যেমন রাজপথের লড়াইয়ে সক্রিয় থেকেছেন, তেমনি সোচ্চার থেকেছেন অনলাইনে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা যেমন এ আন্দোলনের সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি শিক্ষার্থী-জনতার দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ঘরে-বাইরে-প্রবাসে নারীরা প্রকাশ্য রাজপথে ও অনলাইনে সোচ্চার থেকেছেন।
তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে অসীম সাহসিকতার ভূমিকা রাখা সর্বস্তরের নারীদের প্রতিনিধিত্ব আমরা রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে দেখতে পাচ্ছি না। যেন তারা হঠাৎ কোথাও উধাও হয়ে গেছেন। গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল, বৈষম্যমুক্ত সর্বজনের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা। জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি নারীদের বাদ দিয়ে যা কখনোই সম্ভব না। অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র যদি একটি বিশেষ লিঙ্গের, বিশেষ শ্রেণির, বিশেষ জাতি-ধর্ম পরিচয়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে ওঠে, তবে তা হবে শহীদ ও আহতদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি।
তারা বলেন, সন্তানের পাশে মায়েরা রাজপথে যেমন স্লোগানে-মিছিলে থেকেছেন, তেমনি কোনও কোনও নারী আবার খাবার, আশ্রয়, চিকিৎসা, সাহস, অর্থ সাহায্য দিয়ে পাশে থেকেছেন। শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে বিদেশে, ধনী থেকে দরিদ্র, নানান ধর্মের, নানান জাতিসত্তার, সর্বস্তরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, পরিচয়ের নারীরা গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সমাজের অন্য সবার মতোই নারীদের এই সাহসী, নির্ভীক ভূমিকা ছাড়া ১৬ বছরের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও নারীরা প্রকাশ্যে এবং নিভৃতে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
আন্দোলনে ভূমিকা রাখা ডা. অর্থি জুখরিফ বলেন, আন্দোলনের সময় আমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছিল যে আমি তাদের জন্য কিছু করতে পারছি না। একসময় আমার মনে হয়েছে, আমি যদি অন্যদের মতো দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে নিজের কাছে দায়বদ্ধ থাকবো। তখন আমার মনে হয়েছে আমার নিচে গিয়ে তাদের পাশে থাকা উচিত। তখন অনেকে ভয়ের জায়গা থেকে দাঁড়াতে পারেনি। পরে আমরা আমাদের বাসার গ্যারেজে চিকিৎসা দিতে শুরু করি। আমাদের বিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের নারীরা কিন্তু তখন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন তাদের সাপোর্টটা আমাদের ওই সময় অনেক বড় সাপোর্ট হয়েছিল। বাসার গ্যারেজে চিকিৎসা দিতে শুরু করি। আমাদের বিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের নারীরা ছাড়াও অচেনা অনেক নারীরা কিন্তু আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি আমার পেশাগত জায়গা থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে আমার কাজ করে যাবো।
তিনি আরও বলেন, আমি বলতে চাই এখন যেসব সংস্কার কমিশন গঠন হচ্ছে সেখানে কিন্তু নারীরা আছে, তবে আমি চাই নারীদের আরও যুক্ত করা হোক। যে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য আমাদের আন্দোলন সেটা যেন বৈষম্যহীন হয়, সেটাই আমরা চাই।
সাংবাদিক শামীমা সুলতানা লাবু বলেন, আমি একজন সাংবাদিক হবার পরও আমি একজন মানুষ। আমি আন্দোলনের সময় আমার পেশার বাইরে গিয়ে কিন্তু আমার বাসায় অনেককেই থাকতে দিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, একবার আমার হাতে চ্যানেল ২৪-এর বুম থাকার পরও আমাকে বলা হয়েছিল আমি সময়ের (সময় টেলিভিশন) দালাল। আমাকে মেরে ফেলতে হবে।
নিউজ দিতে বাধা থাকার কথা উল্লেখ করে শামীমা আরও বলেন, আমি যখন নিউজ দিতে না পারতাম তখন কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগতো। তখন কিন্তু আমি আমার বসের কনসার্ন নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিউজ দিয়ে দিতাম কোনও না কোনোভাবে। এভাবে কিন্তু আমরা আমাদের কাজ করে গিয়েছি।
শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস নিপু বলেন, আমরা কিন্তু নারীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে দেখলাম নারীদের সাইড করে দেওয়া হচ্ছে।
আন্দোলনে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিপু বলেন, জুলাইয়ে যখন গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়েছিল তখন কিন্তু আমাদের বরিশালে গ্রাফিতি আঁকা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক সেটা করতে হবে। কিন্তু আমাদের কাছে টাকা নেই, রঙ নেই, তুলি নেই, কীভাবে করবো। কিন্তু কীভাবে করবো—সেটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। পরে আমাদের একজন লোক কিছুটা রঙ আর তুলি দিয়েছিল। তখন আমরা কিন্তু দেয়ালে লিখেছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আমি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম বলে কিন্তু আমার পরিবারকে বলা হয়েছিল এলাকায় যদি থাকতে চান তাহলে মেয়েকে থামান। তারপরও কিন্তু আমি নিয়মিত আন্দোলনে ছিলাম।
পোশাক শ্রমিক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমরা সামনের দিকে কীভাবে এগিয়ে যাবো সেটা দেখতে হবে। আমি মনে করি শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই শ্রমিকদের নিয়ে এগিয়ে যাবে বলেই আমি মনে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, যারা নিহত হয়েছেন, যাদের নাম আমরা পেয়েছি তাদের আমরা শহীদ বলে গণ্য করি। কিন্তু যাদের জানি না বা তথ্য পাইনি, তারা কিন্তু শহীদদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। তাই আমি বলতে চাই, যাদের নাম আমরা জানি কেবল তাদের নিউজে না করে নাম না জানা যারা আছেন তাদের নিয়ে কাজ করুন। তাহলে আমরা প্রকৃত শহীদের সংখ্যা জানতে পারবো।
নোয়াখালীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন করা সুমাইয়া রিসু বলেন, আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ছিল সমানভাবে। তাহলে এখন কেন তাদের পাওয়া যাচ্ছে না? আমি বলতে চাই, শুধু পুরুষদের জন্য না, নারীদের উপস্থিতি থাকাতেই এই আন্দোলন সফল হয়েছে।
লড়াকু ২৪-এর সহযোদ্ধা কানিজ ফাতেমা মিথিলার সঞ্চালনায় সংলাপে এসময় বিভিন্ন সংগঠনের নারীনেত্রীসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পেশার নারীর উপস্থিত ছিলেন।