সামান্য উদ্যোগ বাঁচাতে পারে ‘মালতো’ ভাষা ও সংস্কৃতি

চর্চার অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাষা শেখার সুযোগ না থাকায় বিলুপ্ত হচ্ছে ‘মালতো’ ভাষা। আর বাঙালিদের সঙ্গে জীবনযাত্রা মিলিয়ে চলতে গিয়ে এই পরিস্থিতি মেনে নিতে হচ্ছে তাদের। এতে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি সামান্য উদ্যোগ পারে মাল-পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর এই ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে।

মাল-পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট বলছে, দারিদ্র ও শিক্ষার অভাবে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ ‘আদিবাসীদের নিজস্ব উদ্যোগকে সরকারিভাবে সহযোগিতা দিলে এই জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব। দেশের রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় ২০ হাজারেরও কম জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের জন্য নেই কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু প্রাথমিকভাবে নিজস্ব ভাষা শেখার ব্যবস্থা করলেই ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেক্টিভ (আরডিসি) চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আদিবাসী যেসব জাতি রয়েছে তাদের অন্যতম পাহাড়িয়া। এরকম অন্তত ৭৮টা নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছে। বাংলাদেশ সরকার ৫০টি জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখনও কমপক্ষে ২৮টি জাতি-গোষ্ঠী স্বীকৃতি পায়নি, যাদের অনেকেই উত্তরবঙ্গের আদিবাসী। এই স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি। জনসংখ্যার একাংশকে পিছিয়ে রেখে আমরা এসডিজি অর্জন করতে পারবো না। সে জন্য আদিবাসীসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর ভিন্নতার যে স্তরগুলো রয়েছে সেগুলোকে সমানতালে এগিয়ে আনা দরকার। পাহাড়িয়াদের চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। বাংলাদেশে আমরা তিনটি পাই, এদের মধ্যে একটি হচ্ছে সাওরিয়া পাহাড়িয়া, মাল-পাহাড়িয়া, কুমুর পাহাড়িয়া। আর চতুর্থটি বাংলাদেশে থাকতে পারে, কারণ এটি নিয়ে বিস্তর কোনও গবেষণা হয়নি। যদি দ্রুত এই ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে ভাষাটি হারিয়ে যাবে। ভাষা যদি হারিয়ে যায় তাহলে তাদের সংস্কৃতিও হারিয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বহুত্ববাদের কথা বলছেন, তা শুধু কাগজে থাকলেই হবে না, সেই বহুত্বের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের জন্য কী করছেন সেটিই জরুরি বিষয়। আট মাসের বেশি সময় তিনি ক্ষমতায় আছেন আরও যে সময় তিনি থাকবেন— সে সময়ে যদি কার্যকর কিছু করেন, তাহলে সেগুলো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভূমিকাকে জোরালো করবে। গণতন্ত্র তো শুধু ভোটের অধিকার নয়, অস্তিত্বকে জ্ঞাপন করার অধিকারও।’

অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, ‘পাহাড়িয়ারাও একটি বড় জাতিগোষ্ঠী ছিল। বৃহত্তর বাঙলার ইতিহাসে দেখি সাঁওতালদের সঙ্গে পাহাড়িয়াদের বিশাল বিশাল লড়াই হয়েছে। এখনও বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল মিলিয়ে সাঁওতাল এক কোটির বেশি।’

নিজস্ব লিপি না থাকায় মালতো ভাষা রোমান হরফে লেখা হচ্ছে (মালতো ভাষায় লেখা শিশুদের একটি কমিক বইয়ের পৃষ্ঠা)গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরডিসি’র সাধারণ সম্পাদক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যারা তুলে ধরেন তারা হচ্ছেন আদিবাসী। তাদের যে সংগীত, তাদের যে নৃত্য— তাতে দেখবেন সেখানে দলবদ্ধ থাকার ব্যাপারটা রয়েছে। আমরা যেমন বলি, আমার; আর তারা বলেন, আমাদের। এই জায়গা থেকে আমাদের কিছু শেখার আছে। তাদের আলাদা সংস্কৃতি আছে, সভ্যতা ধ্বংস হলেও সংস্কৃতি টিকে থাকে। জাতীয় কবি নজরুলের অনেক গানে কবি ঝুমুর তাল ব্যবহার করেছেন— এটি আদিবাসীদের। মুক্তিযুদ্ধেও অনেক অবদান রয়েছে তাদের। তাদের বিষয়গুলো তুলে ধরাটা এখন মোক্ষম সময়। আমরা বলি, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ, এটি শুধু মুখে মুখে বললে হবে না— তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তার দেশপ্রেমও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গভীর। আমরা প্রকৃতি নষ্ট করে ফেলি, কিন্তু তারা প্রকৃতি বাঁচিয়ে রাখে নিজের বাঁচার জন্যই। তাই তাদের বাঁচিয়ে ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের চাওয়াটাও কিন্তু খুব কম।’

লেখক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শোয়াইব জিবরান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুধু মাল-পাহাড়িয়া নয়, সমতলের নৃগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকেন। এদের ভাষা হারিয়ে গেলে আমাদের বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে, যা আমাদের জন্য এবং তাদের জন্য বিপদজনক। সমতলের নৃ-গোষ্ঠীর মানুষরা দেশ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা পায় না। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আমাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। মালতো ভাষার নিজস্ব কোনও লিপি নেই। সে কারণেই এই সমস্যাটা প্রকট। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে অন্তত তাদের নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানো। তারপর তারা বাংলাভাষায় বা তাদের পছন্দের ভাষায় লেখাপড়া করুক। নিজেদের প্রাথমিক ভাষাটা শিখলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বেঁচে যাবে।’

ভাষা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা

মালতো ভাষা রোমান হরফে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর সচেতন ব্যক্তিরা। তারা মনে করছেন ভাষা টিকিয়ে রাখতে পারলে সংস্কৃতিও রক্ষা করা সম্ভব হবে।

ইউনেসকোর ইন্টারন্যাশনাল ডেকেট অব ইনডিজিনাস ল্যাংগুয়েজেসে (আইডিআইএল) বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও আদিবাসী ভাষাপ্রযুক্তিবিদ সমর এম সরেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে কম্পিউটার কি-বোর্ডের উদ্বোধন করা হয়েছে ২০২৪ সালে। ভাষা টিকিয়ে রাখতে রোমান ভাষার লিপি ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছি। সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দেরি হচ্ছে। প্রয়োজন সরকারি জোরালো উদ্যোগ।’

স্থানীয় পদক্ষেপ

রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলা ও নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার সীমান্তে লালপুরের যোথরামানাথ গ্রামে বাস করে ৩৫ ঘর মাল-পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠী। এই গ্রামে মালতো ভাষার জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্য কারও বাড়ি নেই। এদের মোট জনসংখ্যা দেড়শ’র মতো। এদের একটি অংশ ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান হয়েছেন। তবে বয়স্ক মানুষসহ আরেকটি অংশ ধর্ম পরিবর্তন করেনি।

গ্রামীণ পারিবারিক জীবনে এরা মালতো ভাষা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ও অন্যান্য জনজাতির সঙ্গে বাক্যালাপের সময় স্থানীয় বাংলা ভাষায় কথা বলেন। লেখাপড়া করেন বাংলা ভাষার সাধারণ স্কুল-কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চাকরির হিসেব অনুযায়ী অথবা ভর্তির সুযোগ অনুযায়ী লেখাপড়া করে।

মাল-পাহাড়িয়াদের ঘর-বাড়িস্থানীয় মাল-পাহাড়িয়াদের বক্তব্য

যোথরামানাথ গ্রামের নরেন পাহাড়িয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেকে খ্রিস্টান হচ্ছেন। ফলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বাঙালিরা তাদের অনেক আচার-অনুষ্ঠান পছন্দ করে না। জীবন-জীবিকার তাগিদে তাদের সঙ্গে মিলে থাকতে হয়, ফলে আমাদের সংস্কৃতির তেমন কিছুই আর পালন করা হয় না।’

যোথরামানাথ গ্রামের শ্রীমন্ত পাহাড়িয়া বলেন, ‘রোমান ভাষার লিপি ব্যবহার করে বই তৈরি করা হয়েছে মালতো ভাষায় লেখাপড়া করার জন্য। গ্রামের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিকভাবে ভাষার শেখার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সবাই বাংলা শিখছে। প্রতিষ্ঠান না থাকায় কেউ ব্যক্তিগতভাবে পড়ানোর জন্য ছেলেমেয়েদের শেখানোর আগ্রহ দেখায় না।

শ্রীমন্ত জানান, খ্রিস্টান ধর্ম অনেকেই গ্রহণ করেছেন, খ্রিস্টানদের সহায়তায় একটি গির্জা তৈরি করা হয়েছে। 

যোথরামানাথ গ্রামের কিত্র পাহাড়িয়া বলেন, বাপ-মা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মালতো ভাষায় কথা বলে না। বাঙালিদের সঙ্গে মিশতে হয় বলে সবাই বাংলা শিখছে।

যোথরামানাথ গ্রামের সুবল পাহাড়িয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। তিনি নিজের ভাষা ভালোভাবেই জানেন। তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠান না থাকায় নিজের ভাষা জানলেও লেখা বা পড়া শেখানোর কোনও ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। বাংলা শিখলে চাকরি করা কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যায়, মাতৃভাষা শিখে নিজেদের মধ্যে ছাড়া কথা বলা যায় না, সে কারণেও নতুন প্রজন্ম ভাষা শিখছে না। সরকার উদ্যোগ নিলে হয়তো ভাষাটি রক্ষা পাবে, তাছাড়া সম্ভব নয়।’

সুবল জানান, এখানে শিশুদের বেশিরভাগই মাতৃভাষা জানে না। সবাই বাংলা শিখছে। তাছাড়া আমাদের যে সংস্কৃতি তা একবারেই হরিয়ে গেছে।

মাল-পাহাড়িয়াদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় কিনা জানতে চাইলে নরেন পাহাড়িয়া বলেন, ‘যখন সবার হাতে টাকা থাকে তখন একসঙ্গে করা হয়, তাছাড়া হয় না।

তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নরেন জানান, তাদের সমাজ প্রধানকে বলা হয় সর্দার। আর তাদের দেবতার নাম ‘গোঁসাই’। ‘গোঁসাই’ হচ্ছেন সূর্য্যদেবতা। পুরোহিতদের বলা হয় ‘দেমানো’। দেমানোকে তারা সবচেয়ে সম্মানের চোখে দেখেন। সূর্য ও প্রকৃতির পূজা করেন। উৎসব আর হয় না। হয় না পাঠাবলি দেওয়ার মতো বড় উৎসব। অর্থাভাবে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও গান-বাজনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখনও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে নিজেদের বিনোদন পাওয়ার চেষ্টা করেন তারা।