সারা দেশে এলজিইডির ৩৬ অফিসে দুদকের অভিযান

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) আওতাধীন গ্রামগঞ্জের রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, কাজের গুণগত মান বজায় না রাখা, কাজ না করে কিংবা নামমাত্র কাজ দেখিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট ইউনিট সারা দেশে একযোগে এলজিইডির প্রধান কার্যালয়সহ ৩৬টি কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেছে। 

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) এ অভিযান পরিচালনা করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।

আকতারুল ইসলাম জানান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) বাস্তবায়নাধীন ‘বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি ইমারজেন্সি অ্যান্ড রেসপন্স’ (বি-স্ট্রং) প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম। ২০২৪ সালের বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগের ছয়টি জেলা— ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া— এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষে মোট ১ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে বিশ্ব ব্যাংক এবং অবশিষ্ট অংশ ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার। তবে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই বিভিন্ন জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণের অভিযোগ পায় দুদক। 

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, স্ট্রিট সোলার লাইটের প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৭২ হাজার টাকা। যদিও পরিকল্পনা কমিশনের মতে এসব লাইটের কোনও প্রয়োজনই নেই। একইভাবে, ৬০টি মোটরসাইকেলের প্রস্তাব করা হলেও পরিকল্পনা কমিশন তা কমিয়ে ৩৬টিতে সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। এছাড়া ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণসহ অন্যান্য খাতে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা অস্বাভাবিক বলে মনে করা হয়েছে। বিশেষ করে ৪টি ল্যাপটপের জন্য মোট ১১ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অভিযানকালে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে দুদক টিম, যা যাচাইপূর্বক কমিশন বরাবর বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

গাজীপুর
গাজীপুর জেলা সদরের শিংরাতলি থেকে ভবানীপুর রাস্তার কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগে সরেজমিন পরিদর্শনকালে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের সত্যতা প্রাথমিকভাবে পাওয়া যায়। দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার মিটার রাস্তার কাজ ইতোমধ্যেই শেষ করেছে। সেখান থেকে রাস্তায় ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে নির্মাণাধীন বাকি ১ হাজার ১৮৫ মিটার রাস্তা থেকেও আলাদা নির্মাণসামগ্রীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

কুমিল্লা
কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় কাশিনগর ইউপির যাত্রাপুর থেকে শ্রীপুর ইউপির পারুয়ারা পর্যন্ত ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার সড়ক পরিদর্শনকালে টিম সড়কটির কার্পেটিংয়ের কাজ ডিসেম্বর ২০২৪-এ সমাপ্ত হয়েছে মর্মে জানতে পারে। এছাড়াও পরিদর্শনকালে টিম সড়কটির কিছু জায়গায় জলাবদ্ধতা, ফিনিশিং সমস্যা, কম পুরুত্বের কার্পেটিং এবং সড়কের দুই পাশের শোল্ডার না থাকার চিত্র দেখতে পায়।

যশোর
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খলশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশের চটা ব্যবহারের অভিযোগে অভিযান পরিচালনাকালে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের চারতলা ভবনের গাঠনিক কাজ শেষ হলেও অন্যান্য কাজ চলমান এবং তাতে বাঁশের চটা ব্যবহার করা হয়েছে। স্কুল ভবনের উইন্ডো সিলিং এবং সেলফ ঢালাইয়ের কাজে রড ব্যবহার, ভবনের ৭ ফুট ১১ ইঞ্চি সেলফের ঢালাই কাজে লং ডিসটেন্সে মাত্র একটি রড এবং শর্ট ডিসটেন্সে মাত্র ৩টি রড ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যায়।

গোপালগঞ্জ
গোপালগঞ্জ জেলায় কাশিয়ানী উপজেলার সিংগা হাই স্কুল থেকে রামদিয়া পর্যন্ত ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক কার্পেটিংয়ে অনিয়মের অভিযানে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। টিম জানতে পারে, সড়কের কার্পেটিংয়ের মানে ত্রুটি ছিল এবং কিছু অংশ ভেঙে গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনেও রাস্তার কার্পেটিংয়ের পুরুত্ব কম পাওয়া যায়।

লক্ষ্মীপুর
এলজিইডি, কমলনগর উপজেলা, লক্ষ্মীপুরের একটি চলমান প্রকল্পে রাস্তা নির্মাণে বালুর পরিবর্তে মাটি এবং নিম্নমানের ইটের খোয়া ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে পরিদর্শনকালে কয়েকটি জায়গা খুঁড়ে ইটের খোয়া, বালি এবং মিশ্রণের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসময় রাস্তা নির্মাণে ব্যবহৃত ইটের খোয়া নিম্নমানের মর্মে এনফোর্সমেন্ট টিমের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।

বাগেরহাট
বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার কালিখোলা বলভদ্রপুর কালিমন্দির থেকে বালিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণসহ উপজেলায় এলজিইডির অন্যান্য সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একজন ল্যাব সহকারী সড়কের বিভিন্ন অংশের পরিমাপ এবং সড়কে ব্যবহৃত সামগ্রীর গুণগত মান যাচাই করে। অভিযানকালে দেখা যায়, সড়কে নিম্নমানের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে।

গাইবান্ধা
স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ, ফুলছড়ি, গাইবান্ধার বিরুদ্ধে এডিপির বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে অভিযান পরিচালনাকালে বাস্তবায়িত চারটি প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে প্রকল্পগুলোর মধ্যে চৌধুরিপাড়া গণপাঠাগার এবং একতা সংঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি এবং অন্য একটি প্রকল্পের আংশিক কাজ পাওয়া যায়।

শরীয়তপুর
শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ইউনিয়নের সিকদার মার্কেট থেকে আবেদ আলী মুন্সী কান্দির সড়কে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ও বিটুমিন ব্যবহারসহ রাস্তার আস্তরণ ওঠে যাওয়ার অভিযোগে এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালায়। পরিদর্শনে দেখা যায়, দুই হাজার সাত মিটার দীর্ঘ সড়কের কয়েকটি স্থানে মাটির কাজে ত্রুটি রয়েছে এবং প্রতিশ্রুত ১৭০ মিটার পাইল সাইডিংয়ের পরিবর্তে মাত্র ৫০-৭০ মিটার কাজ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনঃনির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর ও জামালপুর, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়, ঢাকার কেরাণীগঞ্জ, বরিশালের মুলাদী, বগুড়ার শিবগঞ্জ, কক্সবাজারের রামু, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, মাগুরার শ্রীপুর, খুলনার বটিয়াঘাটা, কিশোরগঞ্জ সদর, কুড়িগ্রামের উলিপুর, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, নারায়ণগঞ্জের বন্দর, নোয়াখালীর কবিরহাট, নওগাঁ সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, পটুয়াখালী সদর, পিরোজপুরের নাজিরপুর, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, রাঙামাটির কাপ্তাই ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে পরিচালিত অভিযানে নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়।

অভিযানগুলোর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এনফোর্সমেন্ট টিমগুলো কমিশন বরাবর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।