নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতায় জনমনে আতঙ্ক ও উদ্বেগ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি ঘুরে বেড়াচ্ছে নারী ও শিশুর ওপর সংঘটিত কয়েকটি বর্বর নির্যাতনের দৃশ্য। এসব ঘটনার অধিকাংশের ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। প্রকাশ্যে নারীর ওপর সহিংসতা, কিশোরীদের অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনার ভিডিও ও প্রতিবেদন জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

অপরাধ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ের পরিবেশগত পরিবর্তন এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এ ধরনের ঘটনার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। অনেক অপরাধীর মধ্যেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নারীর চলাফেরার অধিকার সংকুচিত হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রকাশ্যে মারধরের ঘটনাকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে মনে করছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটি বলছে, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন জরুরি। নারী অধিকার সংরক্ষায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে প্রায় ২০ হাজার নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়। মাসে গড়ে দেড় হাজার, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৫০টিরও বেশি মামলা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ৯২৪টি মামলা হয়েছে—এর মধ্যে মার্চে ২ হাজার ৫৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৪৩০টি এবং জানুয়ারিতে ১ হাজার ৪৪০টি। ২০২৪ সালে ১৭ হাজার ৫৭১টি, ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১টি এবং ২০২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬টি মামলা হয়েছে।

পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, গত ৯ মাসে মোট ১৩ হাজার ৮৮০টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মার্চ ও এপ্রিলেই সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে। এপ্রিল মাসেই ঘটেছে ২ হাজার ৮৯টি। এই হিসাবের বাইরেও রয়েছে অজস্র অঘোষিত নির্যাতনের ঘটনা।

কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনা

১২ মে রাজধানীর তেজকুনি পাড়ায় নিখোঁজ হয় পাঁচ বছরের শিশু রোজা মনি। পরদিন একটি ময়লার স্তূপ থেকে তার বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন এবং বুকে গরম পানির ফোসকার দাগ পাওয়া যায়।

৯ মে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে পিকনিকে অংশ নেওয়া নারীদের ওপর হামলার ঘটনায় দুই তরুণীকে প্রকাশ্যে বেল্ট দিয়ে পেটানো হয়। শতাধিক পুরুষ দর্শকের সামনে ঘটনাটি ঘটে এবং কেউই বাধা দেয়নি—বরং মোবাইলে ভিডিও ধারণ ও স্লোগান দেওয়ার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

একইদিন রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় দুই বোন মরিয়ম বেগম ও সুফিয়া বেগমকে খুন করে তাদেরই ভাগনে। সাইকেল কেনার জন্য টাকা চুরির সময় ধরা পড়ে যাওয়ায় সে টেবিলে থাকা ছুরি ও শিলপাটা দিয়ে খালাদের হত্যা করে। হত্যার পর জানাজায়ও অংশ নেয় ওই কিশোর।

১৫ এপ্রিল পল্লবীর বাউনিয়াবাদ এলাকায় গ্যারেজে শিশু আবু বকরের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। তার ভাই গ্যারেজে কাজ করতেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করে এক কিশোরকে গ্রেফতার করে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।

১৮ মার্চ পটুয়াখালীর দুমকিতে কবর জিয়ারত শেষে বাড়ি ফেরার পথে কিশোরী লামিয়াকে অপহরণ করে সাকিব ও সিফাত নামের দুই দুর্বৃত্ত। তাকে ধর্ষণের পর নগ্ন ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানোর হুমকি দেয় তারা। ২৬ এপ্রিল ওই কিশোরী আত্মহত্যা করে।

এই ধরনের আরও বহু ঘটনা রয়েছে, যা সমাজে নারী ও শিশুর নিরাপত্তাহীনতা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন ঠেকাতে পুলিশ বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। হটলাইন চালু করা হয়েছে, যাতে ভুক্তভোগীরা দ্রুত সহায়তা পান।’ এছাড়া থানা পর্যায়ে সচেতনতামূলক সভার আয়োজন ও স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জের ঘটনায় অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। নারী নির্যাতনকারীরা কেউ পার পাবে না—আইনের মুখোমুখি হতেই হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের পেছনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, জেন্ডার বৈষম্য ও সামাজিক অবিচার রয়েছে। অনেক সময় মানুষ নিজেই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধের পর আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও তাদের সামাজিক শাস্তি বা মানসিক সংশোধনের ব্যবস্থা না থাকায় একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এ জন্য অপরাধীদের জন্য মানসিক শিক্ষা এবং ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো জরুরি।’