নিহত দুই নারীর ভাগনে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, জীবনযাপন ছিল উচ্ছৃঙ্খল  

রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ১৪ বছর বয়সী কিশোর ভাগনের হাতে আপন দুই খালা খুনের ঘটনা নিয়ে সর্বত্র চলছে আলোচনা। কিশোর ছেলেটি কেমন করে এমন ঘটনা ঘটালো, এ নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করছেন।

স্বজনদের বরাতে জানা গেছে, ওই ছেলে গত দুই বছর ধরে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতো। জুয়া খেলা ও নেশার জগতে ডুবে ছিল। এর আগে, একবার তার বাবাকেও কোপাতে গিয়েছিল। তার চলাফেরা ছিল কিশোর গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে। এছাড়া সে বহিষ্কৃত হয়েছিল স্কুল থেকেও।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানা যায়, গত ৯ মে মধ্য রাতে নিজ বাসা থেকে মরিয়ম বেগম (৬০) ও সুফিয়া বেগম (৫২) নামে দুই আপন বোনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। টাকা চুরির ঘটনা দেখে ফেলায় একে একে দুই খালাকে নৃশংসভাবে খুন করে ১৪ বছর বয়সী ভাগ্নে। হত্যার পর পোশাক বদলে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সে। পরদিন খালাদের জানাজায়ও অংশ নেয়।

সাইকেল কেনার জন্য খালার অগোচরে তার মানিব্যাগ থেকে ৩ হাজার টাকা চুরি করার সময় তিনি দেখে ফেলেন। ওই সময় ঘটনাটি তার মাকে বলে দিতে চাওয়ায় টেবিলে থাকা ছুরি দিয়ে প্রথমে বড় খালাকে, পরে তার চিৎকারে ছুটে আসা ছোট খালাকে ছুরিকাঘাত এবং শিল-নোড়া দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। ডিবি পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ ও পারিপার্শ্বিক তদন্তের ভিত্তিতে শনাক্তের পর তাকে গ্রেফতার করেছে। গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে দুই খালাকে খুন করার বিষয়টি স্বীকার করেছে সে।

দুই বোনকে হত্যার ঘটনায় গত সোমবার করা মামলায় ভাগ্নে গোলাম রাব্বানী (১৪) খান তাজ আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মনিরুল ইসলামের তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাকে গাজীপুরের টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৪ মে) নিহত মরিয়ম বেগমের স্বামী আলাউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গ্রেফতার গোলাম রাব্বানীর (কিশোর) বাবা কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিলেন, তার ছেলে ভালোভাবে চলছে না। তাকে বেশিদূর লেখাপড়া করানো যাবে না। এসএসসি পাস করার পর টেকনিক্যাল বা ভোকেশনাল কোথাও ভর্তি করিয়ে দেবেন। ওই কিশোরের বাবার বরাতে তিনি আরও বলেন, গত দুই বছর ধরেই তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। তার নিজ বাবাকে একদিন দা দিয়ে কোপাতে গিয়েছিল। টাকা দিয়ে জুয়া খেলার নেশা ছিল ওই ছেলের। চলাফেরা করতো তার চেয়ে বয়সে বড় ছেলেদের সঙ্গে। মিশতো কিশোর গ্যাং সদস্যদের সাথে। এসব বিষয়ে নিয়ে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তার বাবা-মা চিন্তিত ছিল। তার বাবা-মা দুইজনই সরকারি চাকরি করেন।

স্ত্রীকে হারিয়ে ষাটোর্ধ্ব আল্লাউদ্দিন নিজের জীবন নিয়েও এখন শঙ্কায় পড়েছেন। দুই মেয়ে বিদেশে পড়ালেখা করতে চলে যাবে শিগগিরই। এরপর তাকে ঢাকার বাসায় থাকতে হবে একাই। স্ত্রী ছাড়া বাকিদিনগুলো কীভাবে পার করবেন এসব নিয়ে করছেন এখন আক্ষেপ। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্তে হত্যার আলামত ও তাকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি। ওই ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— অতীতে তার চলাফেরা কাদের সঙ্গে ছিল, কাদের সঙ্গে মিশতো, তার সব কিছু খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, ওই কিশোর এর আগেও তার নিজ বাবাকে কোপাতে গিয়েছিল। কিশোর গ্যাং কিংবা যাদের সঙ্গেই চলাফেরা করতো এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

দুই খালাকে খুন করে যেভাবে পালিয়েছিল ওই কিশোর

গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি জানায়, গত শুক্রবার (৯ মে) দুপুরে ১২টার দিকে ঘাতক তাজ যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ার বাসা থেকে প্রাইভেট পড়াতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু সে বাসা থেকে বের হয়ে সোজা বড় খালা মরিয়ম বেগমের শেওড়াপাড়ার বাসায় যায়। এ সময় মাথায় লাল রংয়ের ক্যাপ ও মুখে মাস্ক ছিল। বাসায় প্রবেশের পর বড় খালা বাসায় জানিয়ে এসেছে কি না জানতে চাইলে তাজ উত্তরে জানায়, মা আসতেছে, আমি আগে চলে আসছি। এরপর বড় খালা তার জন্য শরবত বানাতে যায়। আর সেজো খালা (সুফিয়া বেগম) প্লেট-বাটি ধোয়া-মোছা করে বারান্দার দিকে যায়। এই সুযোগে সে বড় খালার রুমে টিভির পাশে রাখা মানিব্যাগ থেকে সাইকেল কেনার জন্য তিন হাজার টাকা চুরি করে।

বিষয়টি তার বড় খালা দেখে ফেললে তাকে গালাগালি ও বকাবকি করে। বিষয়টি কিশোর তাজের মাকে জানানোর জন্য মোবাইল খুঁজতে থাকা অবস্থায় ডাইনিং টেবিলে থাকা লেবু কাটার ছুরি দিয়ে প্রথমে বড় খালার পেটে আঘাত করে। তখন বড় খালা রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে মারতে উদ্যত হলে সে আবার আঘাত করে। তার বড় খালার বাঁচাও-বাঁচাও বলে চিৎকারের শব্দ শুনে সেজো খালা (সুফিয়া) পেছনের অন্য একটি রুম থেকে এসে তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর সে ওই একই চাকু দিয়ে সেজো খালার পেটে একবার আঘাত করলে তিনি মেঝেতে পড়ে যান এবং বড় খালা তখনও ডাক-চিৎকার করছিল। তারপর সে রান্না ঘরের চুলার পাশ থেকে শীল-নোড়া এনে বড় খালার মাথায় একাধিক বার আঘাত করে। পরে সেজো খালাকেও আঘাত করে। তারপর সে বাথরুমে গিয়ে তার হাতে ও মুখে লেগে থাকা রক্ত পানি দিয়ে পরিষ্কার করে। পাশের রুমে গিয়ে তার টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্টে রক্ত লেগে থাকায় পরিবর্তন করে খালাতো বোন মিষ্টি'র ব্যবহৃত একটি জিন্স প্যান্ট ও তার ব্যাগে থাকা আরেকটি রঙ্গিন টি-শার্ট ও ক্যাপ পরে বাইরে থেকে তালা মেরে চাবি নিয়ে বের হয়ে যায়।

ডিবি আরও জানায়, সিএনজিতে করে শনির আখড়া চলে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর বাসার চাবিগুলো ও তার পরিহিত লাল ক্যাপ রাস্তায় ফেলে দেয়। শনির আখড়া পৌঁছার পর চুরির টাকা থেকে ৪৫০ টাকা সিএনজি ভাড়া দেয় এবং বাকি টাকায় রক্ত লেগে থাকার কারণে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। শনির আখড়ায় সিএনজি থেকে নেমে একটি মার্কেটের মসজিদের টয়লেটে ঢুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে তার ব্যাগে থাকা সকালে পরিহিত গোলাপি রঙের পাঞ্জাবি আবার পরিধান করে। তার সাথে থাকা ব্যাগের ভেতর থেকে রক্ত মাখা কাপড়গুলো টয়লেটের ভ্যান্টিলেটর দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর বাসার সামনে এসে জুতায় রক্ত থাকায় সেটিও ফেলে দেয়। পরদিন ১০ মে বিকালে তার সেজো খালাকে দাফন করার জন্য তার নানুর বাড়ি ঝালকাঠির উদ্দেশে রওয়ানা করে।