ঢাকায় পাহাড়ি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংগঠনিক কেন্দ্র মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ ও ‘শাক্যমুণি বৌদ্ধবিহার’ নিয়ে সম্প্রতি বিরোধ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। 'তিন পার্বত্য জেলার সচেতন পাহাড়ি বৌদ্ধ সমাজ' নামে একটি সংগঠনের দাবি— সংঘ ও বিহারের জায়গা দখল করে রাখতে 'বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট' নানা ষড়যন্ত্র করছে। এদিকে ট্রাস্টের প্রধান প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো এই অভিযোগ নাকচ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে বৌদ্ধ ধর্মগুরু ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাথেরো তৎকালীন ঢাকায় বসবাসকারী পার্বত্য বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে সমাজকল্যাণ থেকে ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র নিবন্ধন নেন। পরে ১৯৮০ সালে সংঘের নামে মিরপুর ১৩-তে বিহারের জন্য ১৩.২৭ কাঠা জায়গা বরাদ্দ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে বিহারের সঙ্গেই ১৯৮৩ সালে ৩৬ কাঠা জায়গা বরাদ্দ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার জন্য দিয়েছেন বলে দাবি প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর।
এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিহারের জন্য নির্ধারণ করা জায়গায় কোনও বৌদ্ধবিহার নির্মাণের উদ্যোগ বা সংস্কার কাজ করা হয়নি এতদিনেও।
এ বিষয়ে প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, "১৯৭৪ সালে রাঙ্গামাটিতে প্রতিষ্ঠিত সেবাসংস্থা 'মোনঘর' প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই সংস্থাটি এনজিও নিবন্ধন পায়। সেখানে আমি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এবং ঢাকার যে ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র উদ্যোক্তা ভদন্ত বিমল তিষ্য, সেই মোনঘরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন। ফলে ঢাকায় যে 'ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন' ও 'পারতাজ' ভবনটি বানিয়েছে তা মূলত 'মোনঘর'কে অর্থায়ন করেছে। আর ১৯৮০ সালে রাঙ্গামাটিতে মোনঘরের যে আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় তারই শাখা এই বনফুল শিশু সদন। ১৯৯০ সালে এখানে বনফুল প্রাইমারি স্কুলও চালু করি, যা এখন কলেজ হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমার প্রচেষ্টায় এখানে এত বড় ভবন হয়েছে। এবং আমি জনকল্যাণে এই ভবন ভাড়া নিয়ে স্কুল পরিচালনা করে আসছি। চুক্তি অনুযায়ী, যতদিন মেয়াদ আছে আমি এখানে আছি। পরে যদি ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ মনে করে স্কুল রাখবে না, আমি চলে যাবো।"
সভা থেকে প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিল করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করে এক পক্ষ। সেখানে আহ্বায়ক করা হয় ব্রিগেডিয়ার (অব.) তুষারকে। বাকি সদস্যরা হলেন— মেজর (অব.) তপন, ধীরাজ চাকমা বাবলী, অ্যাডভোকেট নিকোলাস চাকমা ও সুদীপ্ত চাকমা। এই কমিটি ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।
তারা বলেন, ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কয়েকজন সচেতন বৌদ্ধ নাগরিককে হুমকি দেওয়া হয়, যেটিকে একপ্রকার দমনমূলক চাপ প্রয়োগ হিসেবে মনে করছে ঢাকাস্থ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক মালিকানা দাবি এবং হুমকির ঘটনায় বৌদ্ধ সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "আমরা নির্বিঘ্নে ধর্মচর্চা করতে চাই। আমাদের সংঘের কমপ্লেক্স থেকে কলেজ সরিয়ে নিয়ে তারা অন্য কোথাও নিয়ে যাক। আর বিহারের জায়গা দখল মুক্ত করা হোক।"
কমিটির বিষয়ে প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বলেন, "আমি তো কমিটির দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাই। ১৯৮৬ সাল থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। মাঝে দুই বছর ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমি ছিলাম না। আমাকে রিজাইন করতে হয়েছিল। তখন শরদিন্দু শেখর চাকমা এখানের সভাপতি ছিলেন। পরে আবার নির্বাচনে আমাকে সভাপতি করা হয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আমি সংঘের সভাপতি হিসেবে আছি। এর মাঝে ২০১২ সালে নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেই। এই ঘটনা নিয়ে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বিকাশ চাকমা আমার নামে মামলা করেন যে আমি সভাপতি হিসেবে বিজ্ঞপ্তি দিতে পারি না। এটা নিয়ে আমাকে কোর্টে আসা-যাওয়া করতে হয়েছিল।"
"কিন্তু ২০১২ সালে যখন নতুন কমিটি গঠন করা হলো সেখানেও আমাকে রাখা হয়। পরে ২০১৭ সালে আবার কমিটি করা হলে সেখানেও আমাকে রাখা হয়। কিন্তু আমি বলেছি, আমাকে সভাপতি করা হলেও আমি কোনও মিটিং ডাকবো না। তবে ২০১৭-তে যে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রসেনজিৎ চাকমা, তাকে বেশ কয়েকবার বলেছিলাম নতুন কমিটির জন্য মিটিং ডাকার জন্য। কিন্তু তা আর এগোয়নি।"
"সর্বশেষ এ বছর এপ্রিলের ২৫ তারিখ সংঘের সদস্যরা একটি মতবিনিময় সভা ডাকে। সেটা সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ছিল না। কারণ, তারা সভা ডাকার কোনও আগাম নোটিশ দেয়নি। কেবল আমাকে ফোন করে উপস্থিত থাকার কথা বলে। আমি উপস্থিত ছিলাম। সেই মিটিংয়ে আমাকে সভাপতি না করে তারা নিজেরাই আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে ফেলেছে। অথচ আমাদের সংঘের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, পরপর কেউ ৬ মাস চাঁদা না দিলে তার সদস্যপদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। এখন যারা আহ্বায়ক কমিটি বানিয়েছে, তাদের কয়জন শেষ কবে চাঁদা দিয়েছে? তাদের তো সদস্যপদই বাতিল হয়ে গিয়েছে। এখন তাদের কথায় কি আমি পদত্যাগ করবো?"
তিনি আরও বলেন, "সেই মতবিনিময় সভায় আলোচনা হতে পারতো কীভাবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আরও গোছানোভাবে কমিটির নির্বাচনের আয়োজন করা যায়। অথচ তারা সেটা করেনি। আমি তাদের বলেছি, আমি জোর করে থাকছি না। রীতি অনুসারে নির্বাচন দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হোক। তারা কোনও নোটিশ না দিয়ে, সাধারণ সম্পাদকও সংঘের কমিটির সভা ডাকেনি, নিজেরাই মতবিনিময় সভা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।"
বিহারের জায়গায় বিহার নির্মাণ করা হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বলেন, "যেহেতু এখানের একটি অংশের জায়গা এরশাদ সরকার দিয়েছিলেন ইনস্টিটিউট করার জন্য, তাই আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে যেই জায়গাটা বিহারের জন্য ফাঁকা আছে সেটা আমাকে দেওয়া হোক। আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ভবন বানাই। আর বর্তমানে যে বনফুল শিশু নিবাসের জায়গা ও ভবন আছে, সেটি সংঘ ও বিহার হিসেবে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেবো। যদি সংঘের সদস্যরা না চায় তাহলে আমার কিছু করার নাই। তবে যতদিন চুক্তি আছে আমি ততদিন এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে যাবো।"
বিহারের জায়গার বিরোধের বিষয়ে আহ্বায়ক কমিটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার (অব.) তুষার কান্তি চাকমা বলেন, ‘বিষয়টা অত জটিল কিছু না। প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বিহারের জায়গায় স্কুল বা কলেজ ভবন বানাতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে শিক্ষা অধিদফতরেও যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু আমরা তো চাই আমাদের বিহারের জায়গায় একটি বিহার হোক, যেখানে আমরা ধর্ম চর্চা করতে পারি। অথচ প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো উনি পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের প্রধান হয়ে এসব সিদ্ধান্ত একাই নিচ্ছেন। তাছাড়া সংঘের কমিটির মেয়াদও শেষ, সুতরাং নতুন কমিটি হলে তখন বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করা হবে। আর সংঘের কমপ্লেক্সে যে বনফুল কলেজ পরিচালিত হচ্ছে, সেটারও একটা স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, উনি একাধারে বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্টেরও প্রধান, আবার সংঘেরও প্রধান ছিলেন, ফলে অন্য কারও পরামর্শ শোনার আগ্রহ উনি দেখাননি। আর সব কিছু এক সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। আমরা চাই, সংঘের নতুন কমিটি হোক, তারপর বিহারের জায়গায় আমাদের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিহার বানানো হোক। আর স্কুল ও কলেজের বিষয়ে ন্যায্য একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তখন। আমরাও চাই, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কোনও ক্ষতি না হোক।