নিষেধাজ্ঞার পরও যমুনা-কেন্দ্রিক আন্দোলন: আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা নাকি কৌশলী ভূমিকা? 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থেমে নেই যমুনা-কেন্দ্রিক সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বিবেচিত মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার আশপাশে সভা, মিছিল, গণজমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রতিদিনই কোনও না কোনও সংগঠন সেখানে কর্মসূচি পালন করছে। এতে প্রশ্ন উঠছে— রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে অনবরত এসব আন্দোলন থামাতে আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? অবশ্য পুলিশ বলছে, জনভোগান্তি কমাতেই এসব ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে কঠোর না হয়ে কৌশলী ভূমিকায় থাকছেন তারা। 

জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তার স্বার্থে ডিএমপি কমিশনার পুলিশের অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং III/৭৬) এর ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সচিবালয় ও যমুনার আশপাশে যেকোনও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সর্বশেষ গত ১০ মে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সই করা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা এবং আশপাশের এলাকা যেমন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মোড়, মিন্টো রোড এলাকায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা ও গণজমায়েত নিষিদ্ধ থাকবে। একই ধরনের বিজ্ঞপ্তি গত ১৩ মার্চ এবং ২০২৪ সালের ২৬ আগস্টেও জারি করা হয়েছিল।

এরপরও একের পর এক কর্মসূচি

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নিয়মিতভাবে যমুনা ও এর আশপাশে বিক্ষোভ ও সভা-সমাবেশ চালিয়ে আসছে। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে পেশাজীবী ও ছাত্র সংগঠনগুলো একের পর এক কর্মসূচি পালন করছে যমুনা-কেন্দ্রিক এলাকাতেই। গত ৮ ও ৯ মে জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপিসহ কয়েকটি সংগঠন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এরপর ১৪ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে লং মার্চ করতে গিয়ে পুলিশের বাধায় পড়েন। পরে তারা প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের এলাকায় রাতভর অবস্থান নেন এবং পরের দিনও কর্মসূচি পালন করেন। এরপর কয়েকদিন পর ২০ মে পোশাক শ্রমিকরা বকেয়া বেতন দাবিতে ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করে তারাও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের এলাকায় অবস্থান নেন। সবশেষ ২১ ও ২২ মে টানা দুই দিন ইশরাককে মেয়র পদে দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা যমুনা-কেন্দ্রিক সভা-সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এছাড়াও বৃহস্পতিবার (২২ মে) ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার প্রতিবাদেও ছাত্রদলসহ ঢাবির শিক্ষার্থীরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করে হয়েছে।

কী বলছেন আন্দোলনকারীরা?

গত মঙ্গলবার (২০ মে) বকেয়া বেতনের দাবিতে কাকরাইল সমজিদের সামনে বিক্ষোভ করেছে টিএনজেড গ্রুপের কয়েক শতাধিক পোশাক-শ্রমিক। এই এলাকায় আন্দোলন-সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, আইন অমান্য করে কেন বিক্ষোভ করছেন? জানতে চাইলে পোশাক শ্রমিক-নেতা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা গত কয়েক মাস ধরে জাতীয় শ্রম ভবনের সামনে আন্দোলন করে আসছিলাম। আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। এরপরও কোনও সমাধান আসেনি। তাই আমরা ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করেছি। আর এতেই সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি ভালো সমাধান পাওয়া গেছে।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ফাহিমুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে কোনও কিছু ছোট পর্যায়ে সমাধান হয় না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে না গেলে দাবি পূরণ হয় না। এই যেমন আমাদের কিছু দাবি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জানানো হয়েছিল। তারা আমাদের দাবির ব্যাপারে কোনও সমাধান দিচ্ছিল না। পরে যখন আমরা মার্চ টু যমুনা কর্মসূচি পালন করেছি এবং পুলিশের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ ও রাতভর আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছি, এরপর সরকারের সর্বচ্চ পর্যায়ে থেকে একটি সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের বাধ্য হয়ে ওই এলাকায় গিয়ে আন্দোলন করতে হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব কেন?

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আইন প্রয়োগে যদি ধারাবাহিকতা না থাকে, তা হলে আইনের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা কমে যায়। একই এলাকায় কিছু কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হলেও অন্যগুলো নির্বিঘ্নে চললে তা পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত দেয়। এসব ঘটনায় কোথাও কোথাও পুলিশি বাধা দেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নীরব ছিল। এতে প্রশ্ন উঠছে—ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে না কেন? আইন প্রয়োগে প্রশাসন কি ইচ্ছাকৃতভাবে নমনীয় আচরণ করছে?

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজ বলছেন, একই এলাকায় বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করেও যদি তা বাস্তবায়ন না করা যায়, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাদের মতে, আইন সমভাবে প্রয়োগ না হলে রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে সন্দেহ দেখা দেবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কেউ আইন ভাঙলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনও কোনও সময় পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা কৌশলী ভূমিকা নিই, যেন জনভোগান্তি না বাড়ে। এছাড়াও আমরা চেষ্টা করছি, যতটা কম বল প্রয়োগ করে আইন প্রয়োগ করা এবং আইন মানতে বাধ্য করা যায়। তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

যমুনা-কেন্দ্রিক এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফলে এটি শুধু নিরাপত্তা নয়, প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। এখন প্রয়োজন, আইন বাস্তবায়নে সমতা, কঠোরতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা—নইলে এমন নিষেধাজ্ঞা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশকে শুধু কঠোর হলে চলবে না, আইনপ্রয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন কৌশলী হতে হবে বলে মনে করেন নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বর্তমানে পুলিশের প্রতি জনসাধরণের শ্রদ্ধা-ভক্তি কিছুটা কমেছে। ফলে পুলিশ যদি শুধু মারমুখী অবস্থানে থাকে এতে করে পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা রয়েছে। ফলে আন্দোলনকারীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধ বাড়াতে বাহিনীকে বিভিন্ন কৌশলে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে তাদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের আন্দোলনের আগে সমস্যা সমাধানে তৎপরতা বাড়ানো।