এবারের বাজেটে আইএমএফ ও ট্রাম্পের প্রভাব: আনু মুহাম্মদ

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র, বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং বিশ্বব্যাংক আইএমএফ জোট—অর্থনীতির গতিমুখট তৈরি করে এবং তারা এটার সুবিধাভোগী। এবারের বাজেটে আইএমএফ ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে। বাজেটে পরিকল্পিতভাবেই জনগণের কাছ থেকে তথ্য আড়াল করা হয়। 

শনিবার (১৪ জুন) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খান মিলনায়তনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির আয়োজনে ‘বাজেট: দেড় দশকের অভিজ্ঞতা ও অর্থনীতির গতিমুখ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপ্রধান ছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। 

তিনি বলেন, আইএমএফর প্রভাবে বিভিন্ন দেশীয় পণ্য ও শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি কমেছে। অন্যদিকে মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে খুশি করার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ১১০টি পণ্যের শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার হয়েছে, ৬৫টি পণ্যে শুল্ক হ্রাস, ৯টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং ৪৪২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। এসবের ফলে সরকারকে যে রাজস্ব ক্ষতি বহন করতে হবে—মূলত সেটাকে পোষানোর জন্যই ভ্যাট বৃদ্ধি এবং দেশীয় শিল্পের সুবিধাগুলো প্রত্যাহার করেছে সরকার।   

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক মাহতাব উদ্দীন আহমেদ। আলোচনা করেন ডাক্তার অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, প্রকৌশলী ও লেখক কল্লোল মোস্তফা, অধ্যাপক ড. গোলাম রসুল এবং গবেষক ও শিক্ষক ড. মাহা মির্জা।

গত ১৬ বছরের বাজেটের বিশ্লেষণ করে মাহতাব উদ্দীন আহমেদ বলেন, বিগত বাজেটগুলোর প্রধান সমস্যা হল: বাজেটের বরাদ্দের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, রাজনৈতিক উদ্দেশে বাজেটের ব্যবহার করা, অন্যদিকে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ক্রমাগত শতাংশের হিসেবে বাজেট কমিয়ে আনা, অতিধনীদের ওপর থেকে করের ভার অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষ ও সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো, সর্বজন ও সর্বপ্রাণের প্রতি ভয়াবহ হুমকি তৈরি করা, লুটপাট এবং উন্নয়ন ব্যয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়া। গত ১৬ বছরের বাজেটের এসব প্রবণতা থেকে এবারের বাজেটও বের হতে পারেনি। প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় তিনি হিসেব করে দেখান, এই অর্থবছরের এডিপির বরাদ্দের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা ব্যয়িত হবে কেবল আপ্যায়ন, আসবাব কেনা, সেমিনার, স্টেশনারি এবং গাড়ির পিছনে, যার কোনও ন্যায্যতা বা যৌক্তিকতা আছে কিনা সেটা বোঝার কোনও উপায় জনগণের সামনে রাখা হয়নি।

প্রকৌশলী ও লেখক, গবেষক কল্লোল মোস্তফা বলেন, বাজেটে ৫৭ লাখ টিসিবি কার্ডের বরাদ্দের কথা বলা হলেও বাদ পড়া ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ডের কী হবে—তা উল্লেখ করা হয়নি। সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, কৃষি ভর্তুকি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এবং পাঠ্যবই বিতরণ বাবদ যে টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে—সেটা বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াবে মাত্র ৫৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা; যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। এই হার বিশ্বের অনেক নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গড় বরাদ্দের মাত্র চারভাগের এক ভাগ।

ডাক্তার হারুন অর রশিদ বলেন, মানুষের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস, নিরাপদ খাদ্য ও পানির নিশ্চয়তা বিধান করার দিকে স্বাস্থ্য বাজেটের মূল মনোযোগ দেওয়া উচিত। 
অর্থনীতির গতিমুখ নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে গবেষক মাহা মির্জা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত দেশীয় যেসব শিল্প তৈরিতে মানুষ ছিল, সেগুলোর বিকাশের দিকে নজর না দিয়ে বারবারই সরকার বিদেশি কোম্পানির মুখাপেক্ষী হতে চেয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে কৃষি অর্থনীতির বিকাশ বন্ধ হয়েছে, পাবলিক কারখানাগুলো অলাভজনক করা হয়েছে, বন্ধ হয়েছে একের পর এক গার্মেন্টেস, সবকিছু মিলে ইনফরমাল খাতের শ্রমিকের সংখ্যা এখন করে বাড়ছে।

অন্যদিকে অধ্যাপক ড. গোলাম রসুল বাজেটের দর্শন নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে বলেন, বর্তমান বাজেটের রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে হলে আমাদের আশির দশকের নব উদারবাদী কাঠামোগত সংস্কারের দিকে তাকাতে হবে। বাজেটে সেই কাঠামোগত সংস্কারেরই ধারাবাহিকতা চলছে।