সবুজ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে শুরু হয়েছে জাতীয় বৃক্ষমেলা

সবুজে ঘেরা ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয়ে শুরু হয়েছে জাতীয় বৃক্ষমেলা-২০২৫। ‘পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি’—স্লোগানে আয়োজিত এই মেলা শুধু গাছের চারা কেনাবেচার উৎসব নয়, বরং এটি একটি সচেতনতা ভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন বলে জানিয়েছে বন অধিদফতর। যার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে।

প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে মাসব্যাপী এ মেলার আয়োজন করেছে বন অধিদফতর। এবারের মেলায় রয়েছে—১১২টি স্টল, যার মধ্যে ৯২টি নার্সারির এবং এরমধ্যে ডাবল স্টল রয়েছে ১৮টি। এসব স্টল দেশের বিভিন্ন নার্সারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে।

সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও মেলায় অংশ নিয়েছে। অংশগ্রহণকারী দফতরের মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন এবং কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন। নাগরিক সহায়তার জন্য রয়েছে তথ্য সেল, কন্ট্রোল রুম এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব স্টল।

ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজকের বৃক্ষমেলা

জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষমেলার সূচনা হয় ১৯৯৪ সালে বন বিভাগের উদ্যোগে। তবে এই সামাজিক আন্দোলনের বীজ বপন হয়েছিল আরও আগেই। ১৯৯১ সালের ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে দেশের প্রতিটি নাগরিককে একটি করে গাছ লাগানোর আহ্বান জানানো হয়। এরপর ১৩ আগস্ট গাজীপুরের শালনা গ্রামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একটি মেহগনি গাছ রোপণ করে ‘বৃক্ষরোপণ অভিযান ৯১’-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ধীরে ধীরে এ কর্মসূচি পরিণত হয় একটি বৃহৎ জনসম্পৃক্ত সবুজ আন্দোলনে।

বৃক্ষমেলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বন অধিদফতর থেকে জাতীয় বৃক্ষমেলা আয়োজনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়—জনসাধারণকে বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করা; ফলজ, বনজ ও শোভাবর্ধক গাছের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি; উন্নতমানের চারা ও বনায়ন প্রযুক্তি সরবরাহ; পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরা; বৃক্ষ চাষের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা উন্মোচন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট, পুস্তিকা বিতরণ।

যেসব গাছ পাওয়া যাচ্ছে মেলায়

বৃক্ষমেলায় রয়েছে দেশীয় ফল থেকে শুরু করে বনজ, ঔষধি ও ফুলের গাছের চারা। পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধন গাছ, বনসাই, ক্যাকটাস ও নানা রকম ইনডোর প্লান্টও মিলছে এবারের মেলায়। তবে কলাম গাছের চাহিদা বেশি দেখা গিয়েছে।

গাছের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে

মেলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ২০২৪ সালের মেলায় বিক্রি হওয়া চারার সংখ্যা ছিল ৩১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৩টি এবং এর বিক্রয় মূল্য ছিল ১৬ কোটি ২৮ লাখ ৫২ হাজার ১০ টাকা। তার আগের বছর ২০২৩ সালে বিক্রি হয় ২০ লাখ ৭ হাজার ২৮৭টি চারা, যার বিক্রয় মূল্য ছিল ১৫ কোটি ৪৭ লাখ ৯১ হাজার ৩৬০ টাকা। প্রতি বছরই এ সংখ্যা বাড়ছে; যা জনসচেতনতা ও আগ্রহের ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।

মেলায় আসা এক বৃক্ষপ্রেমী জানান, মূলত ছাদ বাগান গড়ে তুলতে মেলা থেকে গাছের চারা কেনা।

মোহাম্মদপুর থেকে আসা ক্রেতা মানসুরা আমিন বলেন, ‘বারোমাসী ফলের চারা কিনতে মেলায় আসা। মেলাতে এক সঙ্গে অনেক নার্সারির স্টল পাওয়া যায়। তাই এই মেলাটার প্রতি আমার বেশি আগ্রহ।’

নিজের রুমের সৌন্দর্য বাড়াতে ক্যাকটাস গাছ কিনতে আসা শিক্ষার্থী নাফিজ ইসলাম বলেন, ‘গাছ দেখতে ভালো লাগে। তাই মেলাতে আসলাম। ভাবলাম আমার রুমের জন্য সুন্দর দেখাবে এমন একটা দুইটা গাছ নেওয়া যায় কী না।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান: প্লাস্টিক বর্জনে দৃঢ় বার্তা

বৃক্ষমেলা ২০২৫-এর উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘জীবন বাঁচাতে হলে পরিবেশ বাঁচাতে হবে। পরিবেশ ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি বর্জনে জাতিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের প্রতিটি নাগরিক যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে সপ্তাহে অন্তত একটা দিন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জন করে, তাহলে ক্রমান্বয়ে প্লাস্টিককের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া কঠিন এ পথে আগানো যাবে না।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বক্তব্য রাখেন।