কাঠামো সংশোধন না করলে হাজার বছরেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না: আদালতে হাবিবুল আউয়াল

আদালতের কাঠগড়ায় বিচারকের উদ্দেশে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। এটা রাষ্ট্রীয় নির্বাচন কাঠামোর সমস্যা। কিন্তু সংবিধান ও আইনের পরিপন্থি কোনও কাজ করিনি। তিনি বলেন, ‘দেশের নির্বাচনি কাঠামো সংশোধন না করলে এক হাজার বছরেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।’

‘বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে রিমান্ড শুনানিকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এদিন দুপুরের দিকে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সাবেক এই সিইসিকে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। বেলা ১টা ২৫ মিনিটে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। ১০ মিনিট পর বিচারকের উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার আসামির ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমি স্বীকার করছি, আমি ডামি নির্বাচন করেছি। রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে একতরফা নির্বাচন হয়েছে। তবে এখানে আমাকে পয়সা দেওয়ার কোনও প্রশ্ন আসেনি। আমার জীবনে আমি অর্থ আত্মসাৎ বা দুর্নীতি করিনি।’

এসময় তাকে থামিয়ে দিয়ে বিচারক বলেন, ‘প্রত্যেক জেলায় নির্বাচনি তদন্ত কমিটি করা হয়। যেখানে একজন যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন। আগে যার ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা, সেটা আপনি ৫ লাখে উন্নীত করেছেন। এতে কি জনগণের টাকা অপচয় হয়নি? এ বিষয়ে তার জানা নেই বলে কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করে হয়তো ভাতা বাড়ানো হয়েছিল।

এরপর বিচারক আবারও বলেন, ‘এই যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল নির্বাচনের সময়, কোথাও কি তারা সরেজমিন গিয়েছিলেন? তখন আউয়াল বলেন, ‘একজন রিটার্নিং অফিসারের অধীনে ৪-৫টা সংসদীয় আসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে সহযোগিতা করতে আরও ৪-৫ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার থাকেন। একটা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্য দুই ভাগ দায়িত্ব কমিশনের, বাকি ৯৮ ভাগ দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে কাজ করা অফিসারদের।’

নির্বাচনের আগে এমন অবস্থা জেনে আপনি পদত্যাগ করলেন না কেন? বিচারকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই অবস্থায় পদত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। আমার এক বন্ধুও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল পদত্যাগের কথা। আমি বলেছি, তুমি যদি আগে বলতা এমন ভয়ংকর নির্বাচন হবে, তাহলে আমি দায়িত্বই নিতাম না।’

তখন আদালত বলেন, ‘আপনার কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু বিতর্কমুক্ত নির্বাচন করতে পারেননি।’ বিগত সময়ের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত ৭৩-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন পেয়েছিল। সেই নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। ক্ষমতার লোভ এমন যে শেখ মুজিবও তা সামলাতে পারেননি। শেখ মুজিবের মতো নেতা নির্বাচনে কারচুপি করেছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে। পরবর্তীকালে তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সংবিধান সংশোধন করে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের নির্বাচন কাঠামো সংশোধন না করলে এক হাজার বছরেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সেটা করার জন্য সংস্কার লাগবে।’

‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (চরমোনাই) সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিমের ওপর হামলার প্রসঙ্গ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উত্থাপন করা হলে আমি বলেছি, তার (ফয়জুল করিম) ওপর হামলার ঘটনায় কথা বলতে গিয়ে আমি কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছি—তিনি কি ইন্তেকাল করেছেন? আমার এ কথাটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।’

তার দীর্ঘ বক্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করেন পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী। এসময় হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘জাস্টিফাই করার সুযোগ না দিলে একটা জীবনকে মেরে ফেলেন।’

পরে পাবলিক প্রসিকিউটর বলেন, ‘এখানে সাধু সাজার সুযোগ নেই। আপনার নিজের অপরাধ ঢাকার সুযোগ নেই। অন্যরা অন্যায় করেছে—এসব না বলে আপনি কী করেছেন সেটা বলেন। তখন পাশ থেকে এক আইনজীবী বলে ওঠেন, ‘এতগুলো ছেলেমেয়ে মারা গেছে আপনার জন্য।’ এর উত্তরে হাবিবুল আউয়াল পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আমার জন্য এতগুলো ছেলেমেয়ে মারা গেছে?’

এদিন রিমান্ড শুনানিকালে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের আগে তিনি (আসামি) শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘সমস্যা নেই। আমি আপনাকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেবো। আর আপনি যে টাকা দেবেন, তা পকেটে ঢুকিয়ে নেবো।’ পিপি বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের যে টাকা দেওয়া হয়, এই আসামি তার হিসাব দেয়নি। এছাড়া সেই নির্বাচনি বরাদ্দের টাকার হিসাব তিনি পেশ করেননি। টাকাগুলো তিনি আত্মসাৎ করেছেন। এ ধরনের ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে, যাতে আগামীতে আর এমন জঘন্য নির্বাচন কমিশনার এ দেশে জন্মগ্রহণ না করে।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘তিনি ৭০ বছর বয়সী লোক। ফ্যাসিস্ট হটাতে গিয়ে আমরা যেন ফ্যাসিস্ট হয়ে না যাই। আমি আসামির রিমান্ড বাতিল ও জামিন প্রার্থনা করছি।’ পরে আসামির জামিন নামঞ্জুর করে তিন দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন বিচারক।

এর আগে গত ২৩ জুন এ মামলায় নুরুল হুদার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পরে বুধবার (২৫ জুন) রাজধানীর মগবাজার থেকে হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।

গত ২২ জুন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে উল্টো ভয়ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপি। সংগঠনের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন খান বাদী হয়ে এ মামলা করেন। পরে গত ২৫ জুন এ মামলায় নতুন করে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারা যুক্ত করা হয়। এ মামলায় শেখ হাসিনা এবং সাবেক ১৫ নির্বাচন কমিশনারসহ মোট ২৪ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়।