সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিলের রায় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতিকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ওই বক্তব্যের জের ধরে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন করলেও আদালত অবমাননার দায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। আদালত অবমাননার বিষয়ে দেশের জনগণকে একটি বার্তা পৌঁছে দিতেই দুই মন্ত্রীকে এ দণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রায় ঘোষণাকালে মন্তব্য করেন।
বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকালে সাবেক রেলমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এই দুই মন্ত্রীর প্রসঙ্গ ছাড়াও কথা বলেছেন সাম্প্রতিক একাধিক বিষয় নিয়ে। খোলামেলা কথা বলেছেন তার সাবেক এপিএস-এর বস্তাভর্তি টাকাসহ ধরা পড়ার দায়ভার এবং নিজের পদত্যাগ নিয়েও।
বাংলা ট্রিবিউন: সম্প্রতি সরকারের দুই মন্ত্রীকে নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? আপনি কি মনে করেন তাদের পদত্যাগ করা উচিত?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: একটি রাষ্ট্র কি কোনওদিন অনৈতিক হতে পারে? এই রাষ্ট্র অনৈতিক হলে জাতি অনৈতিক হয়ে যাবে। দেশ-জাতি-রাষ্ট্র সারাবিশ্বের মানবসমাজ মূল সভ্যতাই সৃষ্টি হয়েছে নৈতিকতার ভিত্তিতে। নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত রাষ্ট্র দেশ বা জাতি মানবকল্যাণে নিয়োজিত হতে পারে না। ন্যায়-নিষ্ঠা বাদ দিয়ে পৃথিবীর কেউ চলতে পারে না। বিচার ব্যবস্থাও হতে হবে ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলেই আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না। একদিকে কেউ ক্ষমা চাইতেছেন। ক্ষমা চেয়েছে তো আপনি ক্ষমা করে দেন না। ন্যায়-নিষ্ঠা বাদ দিয়ে পৃথিবীর কেউ চলতে পারে না। বিচার ব্যবস্থাও হতে হবে ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলেই আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না। বিচার বিভাগকে কেন রিজিট জায়গায় থাকতে হবে। ক্ষমা করে দিলেও তো ঝামেলাটা সেইখানেই মিটে যেত। কিন্তু দেখা গেল জরিমানা করেছেন। তা জরিমানাটা যখন করেই দিয়েছেন তাহলে তোমরা যাও না কেন? উনারা কী নৈতিকতার ঊর্ধ্বে? তাহলে দেশটা চলবে কী করে। তুমি যদি জানো- কোনও ঘরে কেউ ঢুকলে জীবন্ত বের হতে পারবে না, তাহলে কি সে সেই ঘরে ঢুকবে? আমার মত হচ্ছে- এই অবস্থায় সরকারি দল, বিরোধী দল, রাষ্ট্র ও জাতি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নিজের পদত্যাগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে নৈতিক দিক দিয়ে সবাই দায়বদ্ধ। আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি কী কইরা হালাইছে...আমি পদত্যাগ করি নাই? পদত্যাগ করতে হলে আবার কারও কাছে কইয়া করতে হইব নাকি? এটা তাদের ন্যায়-নীতির ওপর। মনে রাখতে হবে- অসামাজিক, অনৈতিক, অন্যায় ও অবিচার কোনওটিই জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুকের গাড়িতে বিপুল অর্থ পাওয়ার খবর প্রকাশের পর তা নিয়ে দেশজুড়ে শোরগোল শুরু হয়। এরপর ১৬ এপ্রিল ‘অর্থ কেলেঙ্কারির’ দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাকে দপ্তরবিহিন মন্ত্রী হিসেবে সরকারে রেখে দেন। পদত্যাগের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্দোষ প্রমাণিত হন।
বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: ঘটনা যে বা যারা ঘটিয়ে থাকুক না কেন এটা সরকারকে বড় দুঃচিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো সুরক্ষিত ও নিরাপদ প্রতিষ্ঠান থেকে এভাবে জনগণের টাকা চলে গেলো চাট্টিখানি কথা নয়। অবাক লাগছে ঘটনার পর মাস হতে চললো আমরা এ দেশীয় দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। সব ক্ষেত্রে শুধু ডিজিটালাইজেশন করলেই হয় না, তা সুরক্ষার ব্যবস্থাও করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় খাতের অর্থে হাত পড়েছে। এ বিষয়ে আরও দায়িত্ব নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে, সে যেই হোক কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। এসব জাতীয় বিষয়, রাষ্ট্রীয় বিষয়, হালকা করে দেখার কোনও সুযোগ নাই। একটা বিষয় কিন্তু দেখতে হবে- আমাদের টাকাগুলো যেখানে গিয়েছে তারা কিন্তু ঠিকই কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিছু টাকাও ফেরত পাওয়ার কথা শুনছি। এই ঘটনায় দায়-দায়িত্ব নিয়ে গভর্নর সাহেব পদত্যাগ করেছেন এটা একটা বিরল আত্মত্যাগ। কিন্তু রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় অর্থমন্ত্রীও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন এবং তিনিও দায় এড়াতে পারেন না। দায়িত্বশীল পদে থাকলে, দায়িত্ব নিয়েই কথা বলতে হবে। আপনাকেও দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। এটা আপনার বা আমার টাকা না। এটা জনগণের টাকা। সব কাজ করবেন শেখ হাসিনা। আর আমরা ইংরেজি কমু, প্রেসের সঙ্গে কথা কমু। কি কয়; রাবিশ-খবিশ, এগুলো কোনও কথা হলো?
বাংলা ট্রিবিউন: বেশ কিছুদিন বিএনপি কোনও আন্দোলনে নেই, এটাকে কী তাদের ইতিবাচক রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ মনে করেন?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: বিএনপি আন্দোলনে নেই বলে তারা সঠিক পথে আছে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। এটা ঠিক গতবছর টানা তিন মাসের জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির পর বিএনপিকে বড় কোনও আন্দোলনে দেখা যায়নি। এর মানে এটা নয় তারা ইতিবাচক ধারার রাজনীতিতে ফেরত এসেছে। তারা ওই আন্দোলনে চরম ব্যর্থ হয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। এখন আন্দোলন করার মতো তাদের কোনও সাংগঠনিক ও নৈতিক শক্তি আছে বলে আমি মনে করি না। আর সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে তাতে আন্দোলনের কোনও ইস্যু সৃষ্টিরই তো কোনও সুযোগ নেই। তবে এটা কথা মনে রাখতে হবে- রাজনীতি ও অপরাজনীতির মাঝখানে যে জায়গাটি রয়েছে সেখানে অনেক ফারাক রয়েছে। বিএনপি গণতান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ায় তাদের অনেক মূল্য দিতে হবে। ঘর পোড়ালো, বাড়ি পোড়ালো এর থেকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য পর্যায় আসতে হলে অনেক সময় লাগবে। খেলতে হয় নিয়ম মেনেই। কিন্তু বিএনপি নিয়মকানুন না মেনে খেলতে গিয়েছিল। যার কারণে তারা বিপর্যয়ে পড়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: সংসদ সদস্যদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্ট নিয়ে সম্প্রতি কথা হচ্ছে, একজন সিনিয়র এমপি হিসেবে আপনি এটা কীভাবে দেখছেন?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: আইনের সমতা সবার জন্য প্রযোজ্য। যার যা মর্যাদা তাকে সেখানে বসাতে হবে। সবকিছুই সাম্যের মধ্যে নিয়ে এলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে না। তবে বর্তমানে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্ট নিয়ে নতুন করে যে কথা উঠছে এর পেছনের কারণ ভিন্ন। আপনারা জানেন- সংসদে এমপি-মন্ত্রীদের বেতনভাতা বাড়ানোর জন্য একটা বিল উঠেছে। এই প্রসঙ্গ তুলে এখন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্ট-এর বিষয় আসছে। আসলে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্ট কোনও সমস্যা নয়। বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রে যখন বেতনের প্রসঙ্গ আসে সবার চাহিদা বেড়ে যায়। এই বিভিন্ন অযুহাতে কেউ বেশি নেওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। আমরা ওনার কাছে সময় চাইবো। উনি সময় দিলে যেসব অসামঞ্জস্য মনে হয়েছে তা তুলে ধরব।
/এএইচ/আপ- এপিএইচ