বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২ এপ্রিল সকাল সোয়া ১১ টার দিকে ধানমণ্ডির ৮ নম্বর সড়কের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সামনে গাড়ি থেকে নামেন দৃক গ্যালারির প্রধান হিসাবরক্ষক ও অ্যাডমিন অফিসার মো. ইরফানুল ইসলাম। এসময় দৃক গ্যালারির গাড়ি চালক নাসির গাড়ি নিয়ে ব্যাংকের বাম পাশের সড়কটির দিকে যান।সেখানে গাড়িটি পার্কিং করে ইরফানুল ইসলামের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এর মধ্যে রাস্তায় পার্কিং করার অপরাধে দৃক কর্মকর্তার ওই গাড়িটি সেখানে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ আটক করে। গাড়িটির কাগজপত্র পরীক্ষা করেন সেইদিন সেখানে দায়িত্বপালন করা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) জাহাঙ্গীর। এনিয়ে চালকের সঙ্গে টিআই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। ইরফানুলকে চালক ফোন করে পুরো ঘটনাটি জানায়। এসময় চালক ইরফানুলকে ব্যাংক থেকে বের হয়ে পাশের সড়কে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে ওঠার অনুরোধ জানান। এর মধ্যে সকাল ১১ টা ২৬ মিনিটে ব্যাংক থেকে ৩ লাখ ৮ হাজার টাকা তুলেন ইরফান।
ওদিকে, টিআই জাহাঙ্গীর গাড়িটিতে র্যাকার লাগিয়ে নিয়ে যেতে চান। এক পর্যায়ে ওই টিআই ১২ শ’ টাকা জরিমানা করে গাড়িটি ছেড়ে দেন। পরে ১১ টা ৪৮ মিনিটের দিকে চালকের সঙ্গে ইরফানুলের কথা হয়। গাড়ি জরিমানা করে টিআই ছেড়ে দিয়েছেন বলেও তিনি তাকে জানান। এসময় পায়ে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠবেন বলেও চালককে ফোনে জানান ইরফানুল। কিন্তু এরপর থেকে ইরফানুলের আর হদিস মেলেনি। ইরফানুলকে বারবার ফোন দিয়েও চালক তার নম্বরটি বন্ধ পান।পরে তিনি ব্যাংকের সামনে যান। ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করে কোথাও তাকে খুঁজে পাননি। বিষয়টি চালক ফোনে দৃক অফিসে জানালে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন দৃক কর্মকর্তারা। জানানো হয় ইরফানুলের পরিবারকেও। এর মধ্যে ইরফানুলের বড় ভাই ইমদাদুল ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা ধানমণ্ডিতে আসেন। দৃকের মহাব্যবস্থাপক এসএম রেজাউর রহমান কলাবাগান থানায় জিডি করেন। ৩ এপ্রিল রবিবার দুপুরের দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ইরফানুল ইসলামের লাশ পাওয়া যায়। তার পরিবারের সদস্যরা নারায়ণগঞ্জ গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।
তিনি আরও বলেন,‘আমাদের কাউকে সন্দেহ হচ্ছে না। কারণ ইরফানুল খুবই নীরব একটা ছেলে ছিলেন। তার কোনও শত্রু নেই। আমার ধারণা, এটা ছিনতাইয়ের ঘটনা। তবে তাকে ঢাকা থেকে কিভাবে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গেল এটা বুঝতে পারছি না। পথে কারও চোখে পড়লো না!’
ইমদাদুল বলেন, ‘গত সপ্তাহে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একবার এসেছিলেন। তিনি কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে। কথা বলেছেন দৃকের সঙ্গেও।’
এ বিষয়ে দৃকের জেনারেল ম্যানেজার এ এস এম রেজাউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন টিআই রংপার্কিংয়ের জন্য গাড়িটিতে রেকার লাগান তখনই চালক ইরফানুলকে ফোন দেন। রেকার ফি ১২ শ’ টাকা দিতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি যখন গাড়িটি টিআই ধরেছিলেন তখনই ইরফান ব্যাংক থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। হয়তো সেই সময় তিনি অপহৃত হয়েছেন।’
এ বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ধানমণ্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) গোলাম মোস্তফা স্বপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে বিষয়টি আমার জানা নেই। ২ এপ্রিল ওই এলাকায় কোন টিম দায়িত্ব পালন করেছে তাও জানি না। ধানমণ্ডি এলাকায় অনেকগুলো টিম কাজ করে। তবে আপনি গাড়ির নম্বর, সময় ও স্থানের নাম আমাকে জানালে আমি খুঁজে বের করতে পারব।’
এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে কলাবাগান থানার ওসি ইকবাল বলেন, ‘আমরা অন্ধকারে দৌড়াচ্ছি। তদন্তে বলার মতো কোনও অগ্রগতি নেই। কিছু বের করতে পারিনি এখনও। এটা নিয়ে দৌড়ের উপর আছি। অনেক দিক নিয়ে কাজ করছি।’
তিনি আরও বলেন,‘শুধু আমরা কাজ করছি না। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কাজ করছে। তবে এখনও কোনও কিছু জানা যায়নি।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তদন্তে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজের উপর জোর দিলেও শেষ মুহূর্তে হতাশ হয়েছে কলাবাগান থানা পুলিশ। কারণ, ধানমণ্ডির ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ও হানিফ ফ্লাই ওভারের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে কিছুই পায়নি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ঢাকার ভেতরেই বন্ধ করা হয় ইরফানুলের মোবাইল। তাই কোন পথ দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে দৃকের চালক নাসিরকে নিয়ে।
কলাবাগান থানার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন,‘ব্যাংকের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দিয়ে কোনও কিছুই উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। পরে হানিফ ফ্লাইওভারের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে তারা। তবে তা দেখে পুলিশ আরও হতাশ। কারণ, ওই সিসি ক্যামেরার ফুটেজে গাড়ির নম্বরই বোঝা যায়নি। পুলিশের ধারণা ছিল, ফ্লাইওভারের ধারণকৃত ফুটেজ দিয়ে গাড়ির ভেতরের মানুষও শনাক্ত করা যাবে।’
ওই কর্মকর্তা বলেন,‘ইরফানুল ইসলামকে ঢাকা থেকে বের করার আগেই তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে তাকে অপহরণের পরই তার ফোনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
দৃকের চালক নাসিরকে ঘিরে প্রথমে পুলিশের সন্দেহ হলে তাকে আটক করে দুই দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে তার কাছ থেকে তেমন কোনও কিছু না পেয়ে তাকে ঢাকা বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।
২ এপ্রিল শনিবার দুপুরে ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পরই নিখোঁজ হন দৃক গ্যালারির কর্মকর্তা ইরফানুল ইসলাম।
দৃকের মার্কেটিং ম্যানেজার তাইমুর রশিদ জানান,ইরফানুল ইসলাম ছিলেন দৃকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। অ্যাকাউন্টসও দেখতেন তিনি। শনিবার দুপুর টাকা উত্তোলন করে চালকের সঙ্গে কথা হয় তার। এরপর নিখোঁজ হন তিনি। তিনি অফিসের গাড়িতে করেই ব্যাংকে গিয়েছিলেন।
পরের দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ইরফানুলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় কলাবাগান থানায় নিহতের ভাই এমদাদুল ইসলাম একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি কলাবাগান থানা পুলিশ তদন্ত করছে।
তাইমুর রশিদ জানান, ১৯৯৩ সালে দৃক গ্যালারিতে যোগ দেন ইরফানুল ইসলাম। তার স্ত্রীর নাম জোহরা বেগম। একমাত্র ছেলে ইফতেখারুল ইসলাম উম্মাম। তারা রাজধানীর হাজারীবাগ থানার মনেশ্বর রোডের ৩৭/১ বাসায় বসবাস করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার লোহাগড়ার আমতলায়।
বন্ধু ও সহকর্মী ইমতিয়াজ আলম বেগ বলেন,ইরফানুল ইসলাম খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের পরিচয়। দৃক গ্যালারির আগে তিনি বাংলাদেশ ফটো সোসাইটির দায়িত্ব পালন করেন।
/এআরআর/ এমএসএম /