৪৫ বছরেও সনদ পাননি সম্মুখ যোদ্ধা মতিউর

মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান

১৯৬৯ সালের পহেলা বৈশাথে কুমিল্লার মুরাদনগরে প্রচণ্ড ঝড় হয়। সেই ঝড়ের খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু তৎকালীণ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নুরুল ইসলাম ও তোফায়েল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন মুরাদনগরে ডাক্তার ওয়ালি আহমেদের বাড়িতে। ঝড়ে ঘর ভেঙে যাওয়ায় তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের একটি হাই স্কুলে। ওয়ালি ডাক্তারের সঙ্গে ছিল আমার আত্মার সম্পর্ক। তিনি এক লোক মারফত খবর দেন আমি যেন তার বাড়িতে যাই। ডাক্তারের বাড়িতে যাওয়ার পর আমি তো হতবাক। তিনি আমাকে ধমকে বলেন, ‘দাঁড়িয়ে কি দেখছো বেটা! উনি আমার প্রিয় নেতা শেখ সাহেব। আর উনি নুরুল ইসলাম ভাই দলের প্রচার সম্পাদক আর উনি তোফায়েল সাহেব।’

পরক্ষণে ডাক্তার ওয়ালি সাহেব বললেন, ‘মতি বঙ্গবন্ধু রাতে থাকবেন কি করি বলো তো। আমি বললাম চলেন বাঁশ আর টিন দিয়ে ছাপড়া বানাই, তিনি বললেন তাই করো। ডাক্তার সাহেব বাজার থেকে টেংরা মাছ কিনে আনলেন বঙ্গবন্ধুর জন্য, আর আমি ছাপড়া বানাচ্ছিলাম। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু বললেন, মতি রাতে দোতারার গান শুনার ব্যবস্থা করতে পারবে? আমি বললাম পারবো স্যার। সন্ধ্যায় ধামঘর ইউপির নহল গ্রামের দো-তারা শিল্পী রমিজ উদ্দিনকে নিয়ে আসি। রমিজ উদ্দিনের গান শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে ১০০ টাকা বকশিস দিয়ে ছিলেন।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকা সুখকর স্মৃতির কথা বললেন মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধা মতিউর রহমান সরকার।

এরপর বললেন ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের কথা। বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে দেখেই বলে ফেললেন, ‘তুমি মুরাদনগরের ওয়ালি ডাক্তারের কাছের লোক মতি। মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছি শুনে বঙ্গবন্ধু আমাকে ৩০০ টাকা পুরস্কার দিলেন। বললেন, আবার মুরাদনগরে যাবো। ওই দোতারা শিল্পীর গান শুনবো।’ এতক্ষণ বেশ আনন্দ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মতিউর রহমান। এরপরই বললেন এতবছরের আক্ষেপের কথা। তিনি বলেন,

‘বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের সনদ পেতে আমাকে এত অপেক্ষা করতো হতো না।’ কারণ সম্মুখ যদ্ধে অংশ নেওয়া এই যোদ্ধা স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও পাননি কোনও সনদ।

যুদ্ধে যোদ দেওয়া প্রসঙ্গে মতিউর রহমান বলেন, ‘পাশের গুঞ্জর গ্রামের হাবিলদার মুনসুর আলী ভাই ছুটিতে বাড়িতে আসলে আমি তার কাছে যাই। তাকে বলি ভাই দশম শ্রেণিতে পড়ি, আমার পড়ালেখা আর ভালো লাগে না। যুদ্ধে যেতে যাই। এই শুনে তিনি বললেন, আমি সৈয়দপুর থার্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আছি। তুমি ওইখানে চলে আইসো, দেখি কি করা যায়। কয়েকদিন পর আমি হাবিলদার মুনসুর ভাইয়ের কাছে যাই সৈয়দপুরে।’

২৫ মার্চের কালো রাত্রির স্মৃতি টেনে তিনি বলেন, ‘মধ্য রাতে তুমুল গুলির শব্দ। দায়িত্বরত সুবেদার আফতাব সাহেব বললেন, তোমরা পেছনের দরজা দিয়ে চলে যাও। আমরা ৭-৮ জন পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে ফুলবাড়ী একটি স্কুলে আশ্রয় নেই। খুব ভোর বেলায় হাবিলদার মুনসুর ও সুবেদার আফতাব দুই থেকে আড়াইশ আর্মি নিয়ে ফুলবাড়ীয়া স্কুল মাঠে আসেন। ওই এলাকার এক আওয়ামী লীগের নেতা একটি গরু জবাই করে সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। শেষে আমাদেরকে নিয়ে সুবেদার আফতাব চলে গেলেন পলাশ বাড়ী। সেখানে গিয়ে তিনি আর্মিদের কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত করেন। স্থানীয় অনেক যুবককে তিনি গ্রুপে অর্ন্তভুক্ত করেন।’

তিনি আরও বলেন, হাবিলদার মুনসুরকে বলে আমি সুবেদার আফতাবের গ্রুপে থেকে যাই। সম্মুখ যুদ্ধে আমার কাজ দেখে আফতাব স্যার আমাকে পছন্দ করতেন। পরে একদল যুবকের সঙ্গে তিনি আমাকে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মানিকারচর পাঠান। সেখানে কিছু দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শুনি আফতাব স্যার গুলিবিদ্ধ হন। এই খবর পেয়ে ওই ট্রেনিং সেন্টার থেকে পালিয়ে চলে আসি পলাশ বাড়ীতে আফতাব স্যারের ক্যাম্পে। এসে দেখি তাঁর দুপায়ে চারটি গুলি লাগে। সুস্থ হয়ে তিনি নিজেই আমাকে অস্ত্র চালানো শেখান। প্রশিক্ষণ শেষে কুড়িমারি, মাতাবের চর, কামালপুর, চিলমারি, রৌমারী সম্মুখ যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করি। সর্বশেষ আমি ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর আমার অস্ত্র জমা দেই। যুদ্ধ শেষে তিনি গ্রামের বাড়ি মুরাদনগরে আসেন।

সনদ না পাওয়ার বিষয়ে মতিউর রহমান বলেন, ‘বিএনপি সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার সময় মুরাদনগর উপজেলার এক মুক্তিযোদ্ধা নেতা আমার কাছে দুহাজার টাকা ঘুষ চাইলেন। আমি বলি টাকা দিয়ে সনদ নেবো না।’    

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ছবি

১১নং সাব সেক্টরের ২ এম. এফ কোম্পানির কমান্ডার বীর উত্তম ও বীর প্রতীক সুবেদার আফতাব বলেন, ‘যুদ্ধের সময় মতি ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের ও বিশ্বস্ত। আমার পায়ে গুলি লেগেছে এই খবর পেয়ে ট্রেনিং সেন্টার থেকে পালিয়ে আসে সে। আমি তার সেবার কারণে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠি। সে সব সময় আমার পাশ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর গুলি ছুড়তো।’

সাবেক গণপরিষদ সদস্য ও একুশে পদক প্রাপ্ত আবুল হাসেম বলেন,  ‘মুক্তিযুদ্ধে মতিউর রহমান ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। তার যুদ্ধকালীন কমান্ডারের সঙ্গে আমার একাধিকবার কথা হয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের সনদ না পাওয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

/এসটি/