রাজধানীতে কমেছে মৌসুমি কসাই, ছুটি পাচ্ছে না দারোয়ান-ড্রাইভার

কোরবানির পশু (ছবি: ফোকাস বাংলা)প্রতিবছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় আগমন ঘটে অপেশাদার বা মৌসুমি কসাইদের। ঈদের দিন কোরবানির পশু জবাইয়ের সংখ্যার তুলনায় পেশাদার কসাইয়ের সংখ্যা কম হওয়ায় এসব মৌসুমি কসাইদের চাহিদাও থাকে আকাশচুম্বি। কিন্তু করোনার মধ্যে কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকা এবং আসা-যাওয়ার ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ায় এই বছর রাজধানীতে মৌসুমি কসাইয়ের সংখ্যা কমেছে। অন্যদিকে অনেকে করোনার সংক্রমণের ভয়ে ‘অপরিচিত’ কসাইসের দিয়ে কাজটি না করিয়ে দায়িত্ব দিচ্ছেন বাড়ির দারোয়ান ও গাড়ির ড্রাইভারদের।

শুক্রবার (৩১ জুলাই) কয়েকজন মৌসুমি কসাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর কোরবানির ঈদের ৫ থেকে ৭ দিন আগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষেরা ঢাকায় আসতেন। এসে কেউ রিকশা চালান, কেউ ভ্যানে করে বা ফুটপাতে বসে কোরবানির পশুর খাদ্য বিক্রি করেন। আর ঈদের দিন ‘একদিনের কসাই’ হয়ে কোরবানির পশুর মাংস কাটার কাজ করেন। কিন্তু করোনার কারণে এই বছর রাজধানীতে স্থায়ী বসবাসকারী নিম্ন আয়ের মানুষেরই কাজ নেই। আবার এই বছর রাজধানীতে বিভিন্ন কারণে কোরবানিদাতার সংখ্যাও কমেছে।

রাজধানীর পরীবাগে কথা হয় দুদু মিয়ার সঙ্গে। তার নির্দিষ্ট কোনও পেশা নেই। সাধারণত বাংলামোটরে টাইলসের দোকানে মাল ওঠা-নামানোর কাজ করেন। আর ঈদের দিন তারা নারী-পুরুষ মিলিয়ে ছয় জনের একটি দল কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানো এবং মাংস কাটার কাজ করেন। ১০ থেকে ১২ বছরের ধরে পরীবাগ ও বাংলামোটর এলাকায় ঈদের দিন এই কাজটি করে আসছেন তারা।

দুদু মিয়াদুদু বলেন, ‘গত বছর বড়-ছোট মিলিয়ে ১২টি গরু এবং তিনটি ছাগলের কাজ করেছি। এই বছর দুইটা গরুর কাজ পেয়েছি। হয়তো আরও কিছু পাবো। তবে, আগের মতো কাজ নেই। গত বছর যেসব মালিক দুইটা গরু কোরবানি দিছে, এই বছর তাদের অনেকে একটা গরু দিচ্ছে। আবার যারা এক থেকে দেড় লাখ টাকা দামের গরু কোরবানি দিতেন, তারা এবার ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মধ্যে কিনছেন। ফলে এবার কসাইদেরও আয় কমে যাবে।’

গরুর দামের ওপর নির্ভর করে কসাইদের মজুরি নির্ধারণ হয় জানিয়ে দুদু বলেন, ‘প্রতি হাজারে তারা এক থেকে দেড়শত টাকা নিয়ে থাকেন। এভাবে গরু-ছাগলের মোট দামের ওপর তাদের মজুরি দিতে হয়।’

রাজধানীর সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের রাস্তার পাশে গরুর ঘাস বিক্রি করছেন পটুয়াখালীর মো. কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন কসাইয়ের কাজ করি। এই কাজের জন্য আজ পটুয়াখালী থেকে আরও পাঁচ জন আসবে। গত বছর ১০ জনের একটি দল থাকলেও এবার কাজ কম থাকায় বাকিদের আসতে নিষেধ করা হয়েছে।’

মো. কাইয়ুমতিনি আরও বলেন, ‘গত বছর ঈদের ৮ দিন আগে তাদের সবাই ঢাকায় এসেছিল। তারপর বিভিন্নজন বিভিন্ন কাজ করেছে। আর ঈদের দিন কসাইয়ের কাজ করেছে। কিন্তু করোনার কারণে এবার ঢাকায় তেমন কাজও নেই, আবার সরকার লঞ্চ ভাড়া দ্বিগুণ করে দিয়েছে। তিনি শুধু এসে গরুর ঘাস বিক্রির পাশাপাশি কোরবানির পশুর মাংস কাটার কাজটি নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত একটি গরুর কাজ পেয়েছেন। আশা করছেন আরও চার থেকে পাঁচটি কাজ পাবেন।’

তার পাশে ভ্যানে করে গোখাদ্য বিক্রি করছেন জামালপুরের সজিব হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘গত বছর আট জনের একটি দল কসাইয়ের কাজ করেছে। কিন্তু এবার দ্বিগুণ বাস ভাড়া দিয়ে এসে কাজ পাবে কিনা, এই সন্দেহে দলের অন্যরা আসেনি। তবে, তিনি অন্য আরেকটি দলের সঙ্গে কসাইয়ের কাজ করবেন ঈদের দিন। তারপর বাড়ি চলে যাবেন।’

কসাইয়ের বদলে দারোয়ান-ড্রাইভার
করোনাভাইরাসের ভয়ে এবার রাজধানীর অনেক কোরবানিদাতা অপরিচিতি কসাইদের না নিয়ে বাড়ির দারোয়ানদের দিয়ে মাংস কাটার কাজটি সেরে নেবেন। তারা বলছেন, করোনা একটি ছোঁয়াচে ভাইরাস। তাই অপরিচিত কোনও ব্যক্তির শরীরে এই রোগ আছে কিনা তা জানা মুশকিল। এই জন্য বাড়ির দারোয়ান ও নিজেরাই এবার কোরবানির কাজ করবেন। তবে, এক্ষেত্রে শুধু পরিচিত কোনও কসাইকে দিয়ে গরুর চামড়া ছাড়ানোর কাজটি করিয়ে নিচ্ছেন।

রাজধানীর পুরানা পল্টন লেনের ৮০/১ নম্বর বাড়ির দারোয়ান কামাল হোসেন জানান, ‘এই বাড়িতে দুই জন দারোয়ানের চাকরি করেন। প্রতিবছর একজন ঈদের ছুটি পেলেও এবার স্যার (বাড়ির মালিক) দুই জনকে থাকতে বলেছেন। কারণ, ঈদের দিন তাদের গরুর মাংস বানাতে হবে। করোনার ভয়ে স্যার এই বছর মাংস কাটার জন্য অপরিচিত কাউকে নিচ্ছেন না।’

একই কথা বলছেন ওই এলাকার ৭৯ নম্বর বাড়ির দারোয়ান মো. মিন্টু। তিনি বলেন, ‘বাড়ির মালিক তাদের দুই দারোয়ান ও গাড়িচালককে এবার ঈদে ছুটি দেয়নি। সবাইকে বলছেন কোরবানির মাংস কাটতে হবে। এজন্য তাদের আলাদা টাকা দেওয়া হবে। অপরিচিত কাউকে এবার এই কাজের জন্য রাখা হয়নি। করোনা আসার পর থেকে স্যার তেমন একটা বাইরেও যাচ্ছেন না।’

বাড়ির নিচে কোরবানির পশু রাখা নিষেধ
রাজধানীর সেগুনবাগিচার ২৪/৪ বাড়ির নিচে কোরবানির পশু রাখা যাবে না বলে ভাড়াটিয়াদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক আনোয়ার হোসেনের এমন সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন ভবনের ভাড়াটিয়ারা। তাই গত বছর যারা রাজধানীতে কোরবানি দিয়েছেন তারা এই বছর কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে দিচ্ছেন। শুধু এই ভবনে নয়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আবাসিক এলাকা জাপান গার্ডেন সিটিতেও কোরবানির পশু রাখা নিষেধ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া মুন্সী মিজানুর রহমান বলেন, ‘গত বছর একটি গরু ও একটি ছাগল কোরবানি দিয়েছিলাম। এই বছর বাড়ির মালিক জানিয়ে দিয়েছেন গ্যারেজে গরু-ছাগল রাখা যাবে না। এই কারণে গ্রামের বাড়ি ফেনীতে কোরবানি দিচ্ছি।’