ডিএসসিসির বাস টার্মিনাল: প্রাক্কলন বাড়িয়ে ‘খাস’ আদায়ের কৌশল!

গুলিস্তানে যেখানে সেখানে থামে বাসঅস্বাভাবিক প্রাক্কলন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গুলিস্তান জয়কালী মন্দির (সায়েদাবাদ সিটি) স্টপওভার বাস টার্মিনালের দরপত্র আহ্বানের অভিযোগ উঠেছে। অতিরিক্ত দর নির্ধারণ করায় টার্মিনালটি ইজারা নিতে কেউ আগ্রহী হচ্ছে না। টেন্ডারেও পড়ছে না কোনও দরপত্র। আর এ সুযোগেই ‘খাস’ আদায়ের মাধ্যমে টার্মিনালের টোল আদায় করছে সংস্থাটি। এতে একটি সিন্ডিকেট উপকৃত হচ্ছে। ফলে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ডিএসসিসি। এর সঙ্গে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, গত বছর এই টার্মিনালটির ইজারা মূল্য পাওয়া যায় ৯৭ লাখ টাকা। কিন্তু এ বছর হঠাৎ করেই তা প্রায় সাড়ে চারগুণ বাড়িয়ে ৪ কোটি ২০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫০ টাকা প্রাক্কলন করা হয়। এর সঙ্গে ঠিকাদারের ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আয়কর যুক্ত হবে। তাই এই প্রাক্কলনকে অস্বাভাবিক বলছেন টার্মিনাল সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে এ বছর টার্মিনালটি ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করলেও তাতে দর জমা পড়ছে না।

টার্মিনাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইজারার জন্য সিটি করপোরেশন থেকে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তা ‘অস্বাভাবিক’। এই দরে কেউ ইজারা নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সিটি করপোরেশন ধার্যকৃত অর্থ আদায় করা সম্ভব হবে না। সে কারণে ইজারা নিতে আগ্রহী নন কেউ। এ সুযোগেই ‘নিজস্ব ব্যবস্থাপনা’র নামে টোল আদায়ের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এতে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে করপোরেশন।

সিটি করপোরেশন বলছে, দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায়ের পর সংস্থার রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে টার্মিনালটি ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু তাতে মাত্রাতিরিক্ত প্রাক্কলন করা হয়েছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এর সঙ্গে জড়িত। কারণ অতিরিক্ত প্রাক্কলন করা হলে কেউ তাতে দরপত্র দেবে না। এই সুযোগেই ‌‌‍‌নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায়ের সুযোগ তৈরি হবে। এ পদ্ধতিতে টোল আদায় করলে ওই সিন্ডিকেটই লাভবান হবে। কারণ তখন আর টোল জমা দেওয়ার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও পরিমাণ বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ফলে আদায়কৃত টোল থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো করপোরেশনের তহবিলে জমা দিলেই চলবে।

নিয়ম অনুযায়ী করপোরেশন নির্ধারিত সরকারি মূল্য না পাওয়া গেলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায়ের বিধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে যাই আদায় হবে তাই করপোরেশনের তহবিলে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে করপোরেশন টোল আদায় সহযোগী হিসেবে তৃতীয় পক্ষকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। তখন ওই পক্ষটি টোল আদায় করে। কিন্তু আদায়কৃত টোল থেকে সব টাকা করপোরেশনের তহবিলে জমা দেয় না। এর সিংহভাগ অংশ নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায়। এই তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীরাই জড়িত থাকেন।

রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্প্রতি এই টার্মিনালটি ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ জন্য টার্মিনালের প্রাক্কলন তৈরি করতে কয়েকটি কমিটি করেন ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এই কমিটির প্রধান ছিলেন ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন। কমিটি টার্মিনাল পরিদর্শন করে এর প্রাক্কলন তৈরি করে। তাতে দেখা গেছে, টার্মিনালের দৈনিক প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ টাকা। যার বাৎসরিক প্রাক্কলিত মূল্য ৪ কোটি ২০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫০ টাকা। এর সঙ্গে ঠিকাদারের ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আয়কর যুক্ত হবে। এ দরে কেউ টার্মিনালটি ইজারা নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ করপোরেশন নির্ধারিত এই প্রাক্কলনের বেশি উঠানো সম্ভব হবে না। এমন আশঙ্কায় কেউ তাতে অংশ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

গঠিত কমিটির সরেজমিন পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে, টার্মিনাল এলাকায় দৈনিক ছোট বড় ১ হাজার ৯৫১টি বাস, ১৬০টি পিকআপ ও লেগুনা এবং ৯৯৮টি সিএনজি যাতায়াত করে। এরমধ্যে ১ হাজার ৯৫১টি বাস থেকে দৈনিক ৫০ টাকা করে ৯৭ হাজার ৫৫০ টাকা, ১৬০টি পিকআপ ও লেগুনা থেকে ৩০ টাকা করে ৪ হাজার ৮০০ টাকা এবং ৯৯৮টি সিএনজি থেকে ১০ টাকা করে ৯ হাজার ৯৮০ টাকা টোল ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে দৈনিক টার্মিনালটি থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ টাকা প্রাক্কলন করে টেন্ডার আহ্বান করার জন্য সুপারিশ করে কমিটি। সুপারিশ অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হলে তাতে মাত্র একজন অংশ নেন। কিন্তু তার দরদেনা ছিল করপোরেশন নির্ধারিত প্রাক্কলনের অর্ধেক। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, একটি সিন্ডিকেট রাজস্ব আদায় বেশি হবে বলে করপোরেশনের শীর্ষ মহলকে বুঝিয়ে এই অতিরিক্ত প্রাক্কলন করেছে। যাতে এই প্রাক্কলনে কেউ টেন্ডারে অংশ না নেয়। টেন্ডারে কেউ অংশ না নিলে তখন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায় করা হবে। তাতে সেই সিন্ডিকেটই লাভবান হবে।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার ফোন করলেও কমিটির প্রধান রাসেল সাবরিনকে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনও সাড়া দেননি। তার দফতরের সামনে গিয়ে সাক্ষাৎ চাইলেও কোনও লাভ হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ওই টার্মিনাল থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায় করা হয়। তাতে সংস্থার তহবিলে দৈনিক ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো জমা পড়ে। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, যদি করপোরেশন তৈরি করা ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ টাকার প্রাক্কলন সঠিক হয়ে থাকে তাহলে বাকি অর্থ কোথায় যাচ্ছে? যদি সেটি সঠিক না হয়ে থাকে তাহলে কার স্বার্থে এই অতিরিক্ত প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে?

টোল বাড়িয়েও রাজস্ব বাড়ানো যাচ্ছে না 

ডিএসসিসির টোল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশে এই টার্মিনাল দিয়ে চলাচলরত পরিবহন হতে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে গত ৩০ জুন থেকে বর্ধিত টোল কার্যকর করা হয়। কিন্তু তাতেও দরপত্রে প্রাক্কলিত দর পাওয়া যাচ্ছে না।

টোল বাড়ানো সংক্রান্ত সিটি করপোরেশনের আদেশে দেখা গেছে, বাস অথবা মিনিবাস থেকে ৩০ টাকার পরিবর্তে ৬০ টাকা, গুলিস্তানে ২০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা, এই দুই টার্মিনালে সিএনজি, অটোরিকশা, টেম্পু ও নাভানা মেক্সিতে ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা এবং পিকআপ ও লেগুনাতে ৩০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি টার্মিনালে মালামাল নামানোর ক্ষেত্রে কুলি মজুরি আদায়ের হারও দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এমন হারে টোল ও কুলি মজুরি ফি বাড়ানোর কারণে ক্ষুব্ধ পরিবহন মালিকরা। বিষয়টি নিয়ে অর্ধশতাধিক পরিবহন কোম্পানির মালিক গত ৬ জুলাই ডিএসসিসি মেয়র বরাবরে আবেদন করেন। আবেদনে তারা বলেন, আমাদের পরিবহনের গাড়িগুলো গুলিস্তান জয়কালী মন্দির, মতিঝিলসহ তার আশপাশের এলাকা থেকে চলাচল করে। এই গাড়িগুলো রাস্তার ওপর থেকে চলাচল করছে। এখানে কোনও টার্মিনাল নেই। আমরা টার্মিনালের কোনও প্রকার সুযোগ সুবিধা পাই না। তারপরেও সিটি করপোরেশন ধার্যকৃত (পূর্বের) টোল ২০ টাকার হারে দিয়ে আসছি। আমাদের গাড়ি থেকে ইজারাদার এখন গুলিস্তান জয়কালী মন্দির, মতিঝিল, গোলাপবাগ মোড়, ধলপুরের উত্তর ঢাল এবং ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের সামনে থেকে ৬০ টাকা হারে টোল আদায় করছে। এটা আমাদের জন্য কষ্টকর।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির মহা-ব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের যে টার্মিনাল রয়েছে সেটার টোল ১৮ বছর আগের ধরা। পরে রাজস্ব বাড়ানোর কথা চিন্তা করে মেয়র বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন দিতে বলেন। কমিটি তার প্রতিবেদনে জানিয়েছে যেহেতু বর্তমান টোলটি ১৮ বছর আগের নির্ধারিত, সেহেতু এটা বাড়ানো উচিত। সে কারণে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে আমরা টোল বাড়িয়েছি। পরিবহন প্রতি বাড়ানো টোলের ওপর ভিত্তি করে প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে। সেটিও কমিটির নির্ধারণ করা।