ধরা পড়ার আতঙ্ক, পর্যাপ্ত খাবারের অভাব আর মানুষের হাতে কোনও কিছু দেখলেই ছুট। বর্তমানে এমনই আতঙ্কে আছে রাজধানীর ধানমন্ডি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কুকুরগুলো। কুকুর ধরার অভিযানের পর মানুষ থেকে এক রকম দূরে থাকছে তারা। এছাড়া খাদ্য সংকটে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে অনেক কুকুর। কুকরগুলোর এমন আতঙ্কিত থাকার কারণ হিসেবে প্রাণিপ্রেমীরা দায়ী করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে। আর কর্তৃপক্ষ বলছে, ঢাকা সিটির ৬০ শতাংশ মানুষ নগরীকে কুকুরমুক্ত দেখতে চায়।
শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি কুকুর নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে আছে। কখনও ভান করছে মরার আবার কখনও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু কাছে গেলেই দিচ্ছে দৌড়। পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে মোটে প্রায় ২০টির মতো কুকুর দেখা গেছে। তবে এগুলোর বেশিরভাগ দুর্বল ও নিস্তেজ। আর ধানমন্ডি এলাকার বেশ কয়েকটি গলি ঘুরেও প্রায় ৪০-৪৫টির বেশি কুকুর চোখে পড়েনি। এই কুকুরগুলোর অবস্থাও একইরকম। দেখেই বোঝা যায়, না খেয়ে আছে বহুদিন। শরীরে নেই চলার শক্তি।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে মানুষ ঘরে অবস্থান শুরু করলে তখন থেকে খাদ্য সংকট শুরু হয় বেওয়ারিশ কুকুরদের। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও খাদ্য সংকটে আছে এই কুকুরগুলো। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ধরা পড়ার আতঙ্ক। খাদ্য সংকটের বিষয়টি বুঝতে পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণিপ্রেমীরা করোনাভাইরাসের শুরু থেকে নিজ উদ্যোগে এই বেওয়ারিশ কুকুরদের খাবার দিয়ে আসছে। সিটি করপোরেশনের কুকুর ধরার খবরে তাদের ভাষ্য, আমরা যাদের নিয়মিত খাবার সরবরাহ করছি বাঁচিয়ে রাখতে, তাদের কেন স্থানান্তর করা হবে। কুকুরের সংখ্যা কমানোর বহু পদ্ধতি আছে। সেগুলো প্রয়োগ না করে কেন তাদেরকে স্থানান্তরের নামে ধুঁকে ধুঁকে মারা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজমল ফুয়াদ বলেন, একটা সময় ঢাকা ভার্সিটির প্রতিটি হলের পাশে প্রচুর কুকুর থাকতো। বর্তমানে হল বন্ধ থাকায় কুকুরগুলো খাদ্য সংকটে রয়েছে। বর্তমানে কুকুরগুলোকে দেখলে মনে হয় তাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বর্তমানে কুকুরগুলো ধরা পড়ার আতঙ্কে হলের পেছনে লুকিয়ে থাকে।
প্রাণিপ্রেমী পিপল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. রাকিবুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মানুষ যখন ক্ষুধার্ত থাকি, মানুষের অত্যাচারে নিপীড়িত থাকি তখন আমরা কিন্তু মানসিকভাবে ভালো থাকি না। আমরাও বিরূপ আচরণ করি। বর্তমানে শহরে যে প্রাণীগুলো আছে তারা ক্ষুধার্ত, শহরের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে তাদের খাওয়ার পানি নাই, ছায়ার জন্য তেমন গাছপালা নেই, আর মানুষের অত্যাচার তো আছেই। এমন অবস্থায় যখন একটা প্রাণী থাকবে, তখন সে ভালো আচরণ ধরে রাখবে এটা আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগর পরিকল্পনার জায়গা থেকে চিন্তা করলে নগরের মানুষ, প্রকৃতি ও এই প্রাণীগুলোর সহবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কুকুরদের দোষ দেওয়ার আগে আমরা কতটা তাদের জন্য করেছি, সেটা আগে ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের অমানবিকভাবে মেরে ফেলার চেয়ে একবারে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলাও ভালো, কিন্তু সেটাও হওয়া উচিত না। কারণ তারাও প্রাণী। তাদের মেরে না ফেলে সংখ্যা কমানোর সিস্টেম কিন্তু আছে। আর সেটা হচ্ছে বন্ধ্যাকরণ। এই সিস্টেমটা অলরেডি ঢাকার উত্তর সিটিতে চালু আছে। তাহলে ঢাকার দক্ষিণে তারা কেন পারছে না?’
বর্তমানে কুকুর স্থানান্তরের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভেটেরিনারি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নগরবাসীর মনমতো করে নতুন কী করা যায়, সেটা নিয়ে আমরা এখন চিন্তা করছি। কারণ, ঢাকা শহরে কুকুর সরানোর পক্ষে ৬০ শতাংশ মানুষ। ২০-২৫ শতাংশ মানুষ না সরানোর পক্ষে। আর বাকিরা কোনও পক্ষেই নেই।’
তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ মানুষ অভিযোগ করেছে কুকুর সরান। কুকুরের যন্ত্রণায় চলাচল করতে পারছি না। তাদের কথা চিন্তা করেই কুকুর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেটা বেশি দূরে না, বুড়িগঙ্গার আশেপাশের খালি জায়গায়। কারণ, ওরা যেখানে থাকবে সেখানেই পরিবেশ তৈরি করে নেবে। অপরপক্ষের অভিযোগ ওঠায় এখন আমরা বন্ধ্যা করার বিষয়টা ভাবছি। তবে এখনও সিদ্ধান্ত আসে নাই।’