অভিভাবকদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ

দেশের ঐতিহ্যবাহী স্কুল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে আকাশি-সাদা ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস-কলতান।

স্কুলের বিভিন্ন স্থানে টাঙানো হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মানার নানা ফেস্টুন। একটিতে লেখা “পৃথিবী সুস্থ হলে আবার খেলবো হাত ধরে/ তার আগ পর্যন্ত সবাই থাকবো ছয় ফুট দূরে”। আবার কোনওটাতে লেখা “স্কুলে আমাদের নতুন বন্ধু হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মাস্ক”।

আবার স্কুলে ঢোকার প্রধান ফটক থেকে ক্লাস রুম পর্যন্ত যেতে দেওয়া রয়েছে গোলাকার চিহ্ন। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে গোলাকার চিহ্নের ভেতরে পা দিয়ে যেতে হয় নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে।

মূল ফটকের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন শিক্ষকরা। তাদের কেউ ফটক দিয়ে ঢোকামাত্র হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে করছেন, কেউ এগিয়ে আসার পর থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে মাপা হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা।

242024687_4658511254199268_4370340358121955550_nএভাবেই স্কুলে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। অনেক দিন বিদ্যালয়ে এসে বন্ধুদের কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাসে মেতেছে তারা। হাত স্যানিটাইজ করেই তাদের কাউকে দোলনায় বসে দোল খেতে, কাউকে দোলনাতে বসে দুজন মিলে গল্প করতে দেখা গেছে।

অনলাইনের ক্লাস কি কোনও ক্লাস ছিল? স্কুলে না এলে, বন্ধুদের না দেখলে, টিচারদের সামনে না বসে ক্লাস করলে কি সেটা ক্লাস হয় - প্রশ্ন এই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী অন্বেষা সরকারের।

দেড় বছর পর স্কুলে এলাম। বাসার দিনগুলো অনেক বোরিং ছিল, নিজে নিজেই বলে গেলো।

প্রথম যখন স্কুল বন্ধ হলো, ভেবেছিলাম- আহ, কতদিন পর বন্ধ পেলাম। কিন্তু ছুটি কাটালাম দেড় বছর। ছুটি কাটিয়ে স্কুলে এলাম - সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, টিচারদের দেখতে পাচ্ছি - খুবই ভালো লাগছে, পাশ থেকে বলে ওঠে অন্বেষার বন্ধু মেধা চৌধুরী।

241908720_819489995405281_791019044170595771_nস্কুলে ঢোকার সময়েই হাতে স্প্রে দেওয়া হচ্ছে, তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে জানিয়ে মেধা জানায়, প্রতিটি বেঞ্চে একজন করে বসানো হচ্ছে। আমাদের সবার কাছেও স্যানিটাইজার রয়েছে। স্কুলের এখানে-সেখানে বেসিন বসানো হয়েছে, লিকুইড সোপ রয়েছে। আমাদের টিচাররা প্রতিটি পদক্ষেপ ফলো করছেন। আমরা নিজেরাও সচেতন, তারপরও টিচারদের চোখ এড়িয়ে কিচ্ছু করার নেই।

এই স্কুলের ভেতরে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কথা জানা গেল মেধা, অন্বেষা, শ্রুতির কাছ থেকে।

কিন্তু বাইরে তো অভিভাবকদের জটলা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী জানালো, বাবা-মায়েরা বুঝতে চাচ্ছে না।

“আমাদের শিক্ষকরা আমাদের জন্য যে ব্যবস্থা করেছে, তাতে আমরা শতভাগ নিরাপদ। কিছু রিস্ক তো থাকবেই, কিন্তু টিচারদের চেষ্টার কোনও কমতি নেই। কিন্তু গার্ডিয়ানরা বুঝতে চাচ্ছে না, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকছে, নিজের কাছে অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না”।

স্কুলের বাংলা ভার্সন ডে শিফটের শাখা প্রধান মো. শাহ আলম খান স্কুলে একটি আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে জানিয়ে বলেন, কোনও বাচ্চা যদি স্কুলে আসার পর অস্বস্তি বোধ করে তাহলে তাকে আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে আসা হবে, এখানে মর্নিং এবং ডে শিফটের জন্য দুজন চিকিৎসক রয়েছেন। তবে স্কুল খোলার আজ দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত কাউকে এখানে আনতে হয়নি।

আজ এ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি, পঞ্চম শ্রেণি, দশম শ্রেণির নতুন এবং পুরাতন শিক্ষার্থীদের ক্লাস হচ্ছে। প্রথম দিনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কম থাকলেও আমরা আশাবাদী সেটা আজ ১০০ শতাংশের কাছাকাছি চলে আসবে।

দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারনে…. কথা বলতে বলতে কিছুটা গলা ধরে আসে প্রবীণ এই শিক্ষকের। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, স্কুলের প্রতি, শিক্ষকদের প্রতি ওদের যে মায়া, ওদের প্রতি আমাদের যে মায়া, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এই বন্ধন তো আজকের নয়, যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। এটাকে কোনওভাবেই থামানো যাবে না। শিক্ষার্থীরা গতকাল প্রথম দিন স্কুলে এসে খুবেই প্রাণবন্ত ছিল, আমরাও তো প্রাণ ফিরে পেয়েছি। মাঠে বেড়াতে থাকা শিক্ষার্থীদের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, আমরা তো এতদিন আজকের দিনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।

আর ওদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে বিন্দু পরিমান কার্পণ্য করি নাই, বলেন মো. শাহআলম খান।

তবে শিক্ষার্থীদের ছাপিয়ে শিক্ষকদের অভিযোগের তীড়টা যাচ্ছে অভিভাবকদের দিকেই।

মগবাজার ইস্কাটন এলাকার একাধিক স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক বলছেন, “অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই‑ পুরো আয়োজনটা কিন্তু আমাদের সন্তানদের জন্য। তারা হয়তো বায়োলজিক্যাল বাবা-মা। কিন্তু আমরাও তো শিক্ষক, ওরাতো আমাদেরই সন্তান। বাবা-মায়ের চেয়ে ওদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ কোনটাই কম নয়।

“‌তাই অভিভাবকদের একটু হলেও ধৈর্যর পরিচয় দিতে হবে- অনুরোধ করছি। তাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য আমাদের।”

“বাচ্চা ক্যাম্পাসে ইন করার পর গেটের বাইরে অপেক্ষা করার দরকার নেই, আপনি চলে যান। ছুটির সময় আবার আসবেন, কিন্তু মানতে চাইছেন না কেউ”।

অভিভাবকরা যদি আমাদের সঙ্গে একটু সহযোগিতা করেন- তাহলে পুরো বিষয়টি আরও সহজ হয়, সুন্দর হয়। অভিভাবকদের বারবার করে বলা হচ্ছে, অনুরোধ করা হচ্ছে, কিন্তু সে অনুরোধ রাখতে চাচ্ছেন না।

ছুটির সময়ে শারীরিক দূরত্ব মেনে, গ্যাপ দিয়ে বের করা হচ্ছে জানিয়ে শাহ আলম খান বলেন, আমরা চেষ্টা করছি।

ডে শিফটে প্রায় ৮০০ বাচ্চা ঢুকবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বের করতে পারবো না জানিয়ে তিনি বলেন, ছোট ক্লাস থেকে আগে শুরু হয়।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হয়তো দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রথম বের করা হবে, তাদের অভিভাবকদের ভেতরে আনা হবে। মাঠের ভেতরে সেকশন অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের লাইন হচ্ছে। প্রতিটি অভিভাবক তার সন্তানকে নিয়ে চলে যাবেন।

দ্বিতীয় শ্রেণি চলে যাবার পর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বের করা হবে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ছাড়া বাকিদের গেটে ভিড় করার দরকার নেই, অথচ সবাই করছেন। আবার পঞ্চম শ্রেণিতে চারটি সেকশন রয়েছে। সেই চারটিও একবারে বের হচ্ছে না। এ-র পর বি, বি-র পর সি, সি-এর ডি সেকশনের শিক্ষার্থীরা যাবে। এরপর দশম শ্রেণি নতুন এবং দশম শ্রেণি পুরাতন-এতটুকু সময় তো তাদেরকে ধৈর্য্যের সঙ্গে আমাদের সাথে থাকতে হবে।

আমি অভিভাবকদেরকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করছি, আপনারা সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ মিনিট আমাদেরকে দেন প্লিজ, বলেন শাহ আলম খান।