টয়লেট যেন লুকানোর জিনিস, জরুরি নয়

বর্তমানে নারীদের বাইরের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বেড়েছে। বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা থেকে শুরু করে সংসারের প্রায় সব কাজই এখন ভাগাভাগি করে নেওয়ার পাশাপাশি পেশাগত কাজেও নারীর অবস্থান বেড়েছে। নারী এখন উদ্যোক্তা হিসেবে সফল। অথচ নগরীর রাস্তায় চলাচলের সময় গণশৌচাগারের সুবিধা তো দূরের কথা, অনেক নারী নিজের কর্মক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যকর টয়লেটের সুবিধাটুকু পাচ্ছেন না।

একইভাবে পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকায় সামান্য আড়াল খুঁজে নিয়ে বিভিন্ন খোলা স্থানে টয়লেট করাকেও স্বাভাবিক করে তুলেছেন পুরুষরা। ওয়াশ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানীতে বিভিন্ন জায়গায় টয়লেট থাকার পরও ওই দূরত্ব পর্যন্ত গিয়ে টয়লেট করতে আগ্রহী নন পুরুষরা। কিন্তু নারীর জন্য রয়েছে নানা ভোগান্তি-লোকলজ্জা, নিরাপত্তাহীনতা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ।

শহরের মধ্যে যা-ও একটু ব্যবস্থা আছে, রাজধানীর বাইরে যেতে লম্বা পথ চলার সময় অনেক ক্ষেত্রেই চাপে পড়তে হয় সবাইকে।

চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘ সময় পানি না খাওয়া ও টয়লেটে না গিয়ে চেপে রাখার কারণে নানা জটিল রোগে ভুগছেন নারীরা। আর ওয়াশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, সবার জন্য স্বাস্থ্যকর টয়লেট নিশ্চিত করতে চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু নানা কারণেই তা সম্ভব হয়নি। পর্যাপ্ত টয়লেট বানানোর পাশাপাশি সঠিকভাবে টয়লেট ব্যবহার ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো নিয়ে মানুষের অভ্যস্ততা বদলাতে গণমাধ্যম ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণা দরকার।

কত টয়লেট আছে?

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১ কোটি ৭৮ লাখ মানুষের জন্য কেবল দক্ষিণে ৭৪টি টয়লেট আছে, যার মধ্যে সচল আছে ৫৫টি। আর উত্তরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা ৯৪। এরমধ্যে সব সচল নয়। আবার সচল বলে দাবি করা অনেকগুলো ভাঙা, নোংরা, ছিটকিনিহীন। ফলে আসলে কতগুলো টয়লেটের সুবিধা রাজধানীবাসী পাচ্ছেন, তা স্পষ্ট করে বলার কোনও সুযোগ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যকর টয়লেট নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সে জন্য সরকারকে ওয়াশ বাজেট বাড়াতে হবে এবং একটি বাস্তব পরিকল্পনা করতে হবে। জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ৩৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশনের আওতাভুক্ত।

রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট

গবেষণা বলছে, ব্যবহারের স্বস্তির অভাব থাকায় এসব টয়লেটের সুবিধা নেন মাত্র ২০ শতাংশেরও কম নারী। যারা গণশৌচাগার নিয়ে কাজ করছেন, তারা বলছেন, টয়লেটের সংখ্যা একদিকে অপ্রতুল, আরেক দিকে নারীবান্ধব না হওয়ার অভিযোগ আছে।

ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে, কেন নারীরা গণশৌচাগার ব্যবহার করতে স্বস্তিবোধ করেন না। আমার অভিজ্ঞতা বলে, বেশিরভাগ গণশৌচাগারে পুরুষ কেয়ারটেকার থাকায় নারীরা নিরাপদ বোধ করেন না। ওয়াশরুমের ছিটকিনি ভালো না। এছাড়া আছে নোংরা পরিবেশ। নারীদের ব্যবহারের জন্য যে টয়লেট, সেটা পরিচ্ছন্ন না হলে তার শারীরিক কারণেই অস্বস্তিকর। এসব দিক আলোচনায় এনে এর প্রতিকারের জন্য প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে।’

আর এই পরিস্থিতিতে অনেকক্ষণ প্রস্রাব ধরে রেখে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন নারীরা। টয়লেট সমস্যা এড়িয়ে যেতে তারা পানি কম খান। ফলে প্রস্রাব-সংক্রান্ত সংক্রমণে পড়তে হয় তাদের।

কেবল টয়লেট করার জন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে আসা এক নারী বলেন, ‘পাবলিক টয়লেটে পুরুষের পাশ দিয়ে যাওয়া একটু সংকোচের। ওগুলো কেমন যেন অপরিচ্ছন্নও লাগে। মেয়েদের একটু বেশি জায়গা লাগে। সঙ্গে যখন কেউ থাকে না, তখন ব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে টয়লেটে যাওয়া বিরক্তিকর লাগে। আবার জায়গাটা নিরাপদ কিনা, সেই অস্বস্তিও লাগে। প্রয়োজনের সময়, বিশেষ করে কোথাও যাওয়ার সময় যদি পথে টয়লেট না পাওয়া যায়, তাই কম পানি পান করাটাই সমাধান।’

লজ্জা থেকে বড় রোগ: কী প্রতিকার?

চিকিৎসক, গবেষক ও সামাজিক বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে শহুরে এলাকার কর্মজীবী নারীরা এবং শিক্ষার্থীরাই মূলত বাড়ির বাইরে বেরোলে টয়লেট চেপে রাখেন। এ জন্য কেবল রাস্তাঘাটে পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতা দায়ী নয়, কর্মস্থল, শপিং মল, হাসপাতাল কিংবা পার্কের মতো পাবলিক প্লেসে টয়লেটের, বিশেষ করে ব্যবহার উপযোগী টয়লেটের অপ্রতুলতা দায়ী।

রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট

টয়লেট চেপে রাখার কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেবল টয়লেট চেপে রাখার কারণে মূত্রনালির সংক্রমণসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। ‘এর ফলে সবচেয়ে বেশি হয় ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন বা ইউটিআই, যাকে বলা হয় মূত্রনালির সংক্রমণ। এটা হয়ই বেশিক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখলে ব্লাডারে যে জীবাণু জন্মায় তা থেকে। এটা পরবর্তীতে অন্য সমস্যা তৈরি করে।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রস্রাব চেপে রাখার কারণে ব্লাডার ফুলে যেতে পারে। সেই সঙ্গে কারও যদি আগে থেকে কিডনিতে কোনও সমস্যা থাকে এবং তিনি যদি নিয়মিত প্রস্রাব চেপে রাখেন, তাহলে ক্রমেই তার কিডনি কার্যক্ষমতা হারাতে শুরু করবে।

করণীয় বলতে গিয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতা তৈরির কথা বলা হয়ে থাকে। ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গণশৌচাগারগুলো ব্যবহার উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই একটা প্রচারণার ব্যবস্থা করা উচিত। একই সঙ্গে এই স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণে নাগরিকের দায়িত্বগুলোও স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।’

বিষয়টি নিয়ে একেবারেই গণমাধ্যমে লেখালেখি নেই উল্লেখ করে শ্যামল দত্ত বলেন, ‘ঢাকা শহরে কোথায় নারীবান্ধব টয়লেট আছে, সেটাও গণমাধ্যমগুলো থেকে কখনও জানানো হয় না। এটা এমন একটা সামাজিক ইস্যু, যেটা তুলে ধরা উচিত। একটা আইন আছে, যেখানে বলা হয়েছে, পেট্রোল পাম্পগুলোয় নারী-পুরুষের জন্য আলাদা টয়লেট থাকতে হবে। সেটাও দেখার কেউ নেই। যেটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেটা কতটা মানা হচ্ছে, তা তুলে ধরাও গণমাধ্যমের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’

রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট

তা-ও নাকি বাংলাদেশ ভালো

পাবলিক টয়লেটের যেটুকু সুবিধা, তা রাজধানীকেন্দ্রিক। অন্যান্য শহরে নারীর জন্য তেমন কোনও বিবেচনা করা হয়নি এখনও। তারপরও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে প্রকাশ্যে মলমূত্র ত্যাগের পরিস্থিতি ভালো।

বিশ্ব টয়লেট দিবস উপলক্ষে নতুন প্রকাশ করা এক রিপোর্টে ওয়াটারএইড নামে একটি সংস্থা বলছে, ভারতে এখনও ৭০ কোটি লোক প্রকাশ্য স্থানে বা অনিরাপদ টয়লেটে মলমূত্র ত্যাগ করে, কিন্তু তাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রকাশ্যে এ কাজ করা ‘প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত’ হয়ে গেছে। একেবারে প্রাথমিক স্তরের টয়লেট সুবিধা নেই এরকম লোকের সংখ্যা ভারতে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।