মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস শেখাতে হবে

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশের আঁতুড়ঘর হচ্ছে শিক্ষা। এই শিক্ষাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষে বিনির্মাণ করতে না পারায় গত ৪০ বছর ধরে বেশ কয়েকটি প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই এই বিভক্ত জাতির বিভাজন দূর করতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তকরণসহ আমাদের সমাজ ও পরিবারে এর চর্চা বাড়াতে হবে।

শনিবার (৮ এপ্রিল) রাজধানীর বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে এডিটরস গিল্ড আয়োজিত ‘স্বাধীনতার অবিনাশী চেতনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন।

বৈঠকে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সংগঠক আমির-উল ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মূল বিষয়টা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। কিন্তু আজকের দিনে এই তিনটাই উল্টে গেছে। এগুলোকে মূল্যায়ন করছি না। বই-পুস্তকেও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়ানো হয় না। এবং আমাদের সমাজে নতুন প্রজন্ম এই তিনটির একটিও খুঁজে পায় না। এটি হচ্ছে বড় দুঃখের। দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যেটা গড়ে ওঠার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না। এবং সাম্য না হয়ে এটা বৈষম্য হচ্ছে। মানবিক মর্যাদা না হয়ে অমানবিকতার মধ্যে আছি। আর সামাজিক ন্যায় বিচার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষার্থে পাঠপুস্তক, শিক্ষক ও সমাজে এর চর্চা বাড়াতে হবে।’

শিক্ষাবিদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘৭৫ এর আগে বঙ্গবন্ধু যখন শাসন করছিলেন, তখন বই পুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের কথা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা ছিল, চার রাষ্ট্র নীতির কথা ছিল। ৭৫ এর পরে এগুলো রাতারাতি বদলে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর নাম ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাও এক পাশের কথাবার্তা। এইভাবে কয়েকটি প্রজন্ম গেছে যাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পর যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসলো, তখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বই-পুস্তকে নিয়ে আসলো। এখন প্রত্যেকটি বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক কথা আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করার জন্য চেষ্টা হচ্ছে।’

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘সংবিধানের অধিকার এবং জনগণের অধিকার আদায়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনটি বঙ্গবন্ধু অসাধারণ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা নিয়ে করলেন, আমরা কিন্তু এখনও তার পুরো মাত্রাটা অনুধাবন করতে পারছি না। ফলে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এই মূল্যবোধটাকে আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নিয়ে যাবো। তার অর্থ হচ্ছে এটাকে সার্বজনীন মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃত করতে হবে, তারপর রাজনৈতিক বিভাজন থাকবে, মত পার্থক্য থাকবে। নানা সমালোচনা, আত্মসমালোচনা পারস্পরিক থাকবে।’

সাবেক চেয়ারম্যান ইউজিসি অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘৭৫ এর পর আমরা তিনটি প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলেছি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে নাই। এখানে আমি তাদের দোষ দেবো না, এটা আমাদের দোষ, পরিবারের দোষ, পক্রিয়ার দোষ, স্কুলিংয়ের দোষ। এসব তো স্কুলে শেখানোর কথা। আর এগুলো বাস্তবায়ন করার কথা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের৷ আর তারা কি করেন? সচিবালয় কক্ষে বসে আরাম করেন। কিন্তু বাহিরে কি হচ্ছে তা জানেন না। এখন সরকারের মধ্যে অনেকগুলো সরকার হয়েছে। তাদের ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন। আর বড় অংশ এগুলো বিশ্বাস করেন না। তারা বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অতীতে ৫০ বছর আগে কি হয়েছে তা নিয়ে চিন্তা নেই।’

গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবুর সঞ্চালনায় গোল টেবিল বৈঠকে আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন দৈনিক সমকালের সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ৮ এর সাব সেক্টর কমান্ডার বীর বিক্রম মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ, ইতিহাসবিদ ও গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।