সহিংসতা ঠেকাতে পারেনি ইসি, পঞ্চম ধাপে নিহত ১০

নির্বাচনি সহিংসতানানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও সহিংসতা ঠেকাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শেষ দুই ধাপে কিছুটা ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত কমিশন সফল হতে পারেনি। বরং আগের চার ধাপের ধারাবাহিকতায় শনিবার অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপের ভোটের সময়ও সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, জালভোটসহ ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এ ধাপে ভোটের  সময় সারাদেশে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহতও হয়েছেও শতাধিক। সার্বিক বিবেচনায় আগের চার ধাপের তুলনায় পঞ্চম ধাপের ভোট বেশি ‘খারাপ’ হয়েছে বলে মনে করে খোদ কমিশনও। এবারের সহিংসতা অন্যগুলোর তুলনায় বেশি হওয়ার বিষয়টি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নিজেও স্বীকার করেছেন।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম চার ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, জালিয়াতি, কারচুপি ও অনিয়ম হওয়ার কারণে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। যে কারণে কমিশন খানিকটা নড়েচড়ে বসে। পরিকল্পিত ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের শেষ দুই ধাপে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ভাবমূর্তি ফিরিতে আনার উদ্যোগ নেয় কমিশন। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দেয় ইসি। এর পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনকেও কড়া নির্দেশনা দিয়ে পৃথক চিঠি ইস্যু করা হয়। এ সময় সিইসি নিজেই সহিংসতাপ্রবণ চট্টগ্রাম বিভাগে সফর করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে ভোটের সময় নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে কঠোর নির্দেশনা দেন। কিন্তু ইসির এসব ব্যবস্থার কোনওটিই কাজে আসেনি। বরং ৫ম ধাপে আগের ধাপগুলোর তুলনায় বেশি সহিংসতা-প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে শনিবার নির্বাচনি সহিংসতায় জামালপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, পঞ্চগড় ও কুমিল্লায় দশজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে জামালপুরে ১ কিশোরসহ ৩ জন, নোয়াখালীতে ১ বৃদ্ধসহ ২ জন, চট্টগ্রামে ১ মেম্বার-প্রার্থীসহ ২ জন, নারায়ণগঞ্জে ১ জন, পঞ্চগড়ে ১ জন এবং কুমিল্লায় ১ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মৃত্যু হয়। শনিবারের ১০ জন মিলে চলমান ইউপি নির্বাচনে এ পর্যন্ত ৯১ জন নিহত হয়েছেন। অবশ্য বেসরকারি সংগঠন সুজনের দাবি অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ১১২ জন।

উল্লেখ্য, বিগত চারটি ধাপে ভোট গ্রহণের দিনে মোট ২৭ জন নিহত হলেও এ ধাপেই ভোটগ্রহণ সময়কালে (সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪টা) বেশি মারা গেছেন। প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিনে নিহত হন ১১ জন। এর মধ্যে ভোটের সময় নিহত হয় ৩ জন এবং বাকি ৮ জন ভোটের পর রাতে মারা যান। দ্বিতীয় ধাপে নিহত ৮ জনের মধ্যে ভোটের সময় মারা যায় ৪ জন।  পরে ৪ জন। তৃতীয় ধাপে ভোটের সময় কেউ নিহত হননি। তবে ভোটের পরে রাতে ২ জন নিহত হয়েছিলেন। ৪র্থ ধাপের ভোটে নিহত ৬ জনের মধ্যে ৩ জন মারা যান ভোট গ্রহণকালে। বাকি তিনজন মারা রান ফল প্রকাশের পরে। 

আরও পড়তে পারেন: বিচ্ছিন্ন সহিংসতায় ভোটগ্রহণ শেষ, নিহত ৮

জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের কুঠারচর ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত ও একই দলের বিদ্রোহী সমর্থকদের মধ্যে জাল ভোট দেওয়া নিয়ে সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার শেখপাড়ার আফজাল শেখের ছেলে মাজেদ মিয়া (১৫), একই এলাকার নূর ইসলাম (৫০) ও কুতুবের চর গ্রামের জিয়াউর রহমান (৩৩)।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ বেগমগঞ্জ উপজেলায় পৃথক নির্বাচনি সংঘর্ষে ২ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় মাথায় আঘাত পেয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে কোম্পানিগঞ্জ থানার ওসি সাজিদুর রহমান সাজিদ জানিয়েছেন। নিহত ব্যক্তির নাম সৈয়দ আহমেদ (৬৫)।

নোয়াখালীর সেনবাগের ইয়ারপুল হাই স্কুল ভোটকেন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ব্যালট

বেলা দেড়টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার বড় উঠান ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বারপ্রার্থী মো. ইয়াসিন (৩৫) ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, তিনি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন।

কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নে বিএনপির বিদ্রোহী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মো. কামাল উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বেলা তিনটার দিকে বলরামপুর ইউনিয়নের নাগেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের বাইরে এ ঘটনা ঘটে।

এছাড়া, নির্বাচন চলাকালে সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নওগাঁ ও ঝিনাইদহসহ বেশ কয়েকটি জেলা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

শনিবারের নির্বাচনে অন্তত শতাধিক প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন। বর্জনকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিএনপি মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী।

আরও পড়তে পারেন: জালভোট কমলেও সহিংসতা বেড়েছে: সিইসি

 তবে এ দফার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের  একাধিক প্রার্থীও নির্বাচন বর্জন করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

পঞ্চম ধাপে অনুষ্ঠিত ৭১৭টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫৩টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে বলে কমিশন জানিয়েছে। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সিইসি জানান। এর আগে প্রথম ধাপে ৬৫টি, দ্বিতীয় ধাপে ৩৭টি, তৃতীয় ধাপে ২৯ ও পঞ্চম ধাপে ৫১টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করে কমিশন।

শনিবার ভোট চলাকালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে গিয়ে একাধিক কমিশনারকে সহিংসতা অনিয়ম ও জালভোট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কমিশনার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি শেষ দিকের নির্বাচনগুলোকে অন্তত কিছুটা হলেও ভালো হোক। সেই অনুযায়ী বেশ কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ব্যবস্থার প্রাপ্তি হলো না। তুলনা করতে গেলে এই ধাপের চেয়ে আগেরগুলোকে ভালো বলতে হবে বলে এই কমিশনার মন্তব্য করেন।

নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা না পাওয়ায় তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

দলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহীদের কারণে গোলযোগের প্রবণতাও বেড়েছে স্বীকার করে আবু হাফিজ বলেন, মানসিকতার পরিবর্তন না হলে গোলযোগ ও অভিযোগের শেষ হবে না।

ভোটের পর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সিইসি ভোটের সময় সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ ধাপে ভোটের আগে রাতে সিলমারাসহ জালভোট কমেছে। তবে সহিংসতা বেড়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে কিছু জায়গায় সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষে অনেকেই আহত-নিহত হয়েছেন। সিইসি বলেন, এ ধাপের নির্বাচনে কিছু জায়গায় অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। যেখানেই অনিয়ম হয়েছে, সেখানের ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, ভোটের যে হাল-অবস্থা, তাতে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ দিয়েই বা লাভ কী? দেশজুড়ে ভোট জালিয়াতি ও ডাকাতি। ইসি জেনেশুনেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কমিশন জেগে-জেগে ঘুমাচ্ছে। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সরকারি দলকে সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে পরিস্থিতির তো কোনও উন্নতি হচ্ছে না। শনিবার পঞ্চম ‍ধাপেও ৮ মারা গেছেন। যারা নির্বাচন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত, তাদের ​বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

/এমএনএইচ/