জলবায়ু প্রকল্পে অনিয়ম

লবণাক্ততায় মরে গেলো সব চারা

জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) নিয়েছে সরকার। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতির গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। এ প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব।

 

একটি চারাও টিকলো না

নোয়াখালীর হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চর ‘নিউ চর জোনাক’। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে এর ৪০ হেক্টর জায়গায় বিভিন্ন জাতের চারা রোপণ করে বন বিভাগ। দ্বীপের উপজেলা সদর ওছখালীর ১০ হেক্টরেও মাউন্ড (স্তূপাকৃতির) বনায়ন করা হয়। একই সময় জাহাজমারা রেঞ্জের নিঝুমদ্বীপে ৮ হেক্টর এবং নলচিরা রেঞ্জে ১০ হেক্টরেও বনায়ন করা হয়। কিন্তু মাটির লবণাক্ততায় একটি চারাও টেকেনি। আবার চারা রোপণ না করে অর্থ উত্তোলনের অভিযোগও উঠেছে বন বিভাগের বিরুদ্ধে।

বন বিভাগ বলছে, জোয়ারের পানি ও অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে চারাগুলো মরে গেছে। উপকূলীয় বন বিভাগ (নোয়াখালীর)-এর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোয়ার ও বন্যায় সমুদ্রের পানি সমতলে এলে লবণাক্ততায় গাছ মারা যায়। এটা পরীক্ষিত। এ অঞ্চলের গাছগুলো কেন মারা গেছে ফাইলপত্র দেখে বলতে হবে। লবণাক্ত স্থানে কেন গাছ লাগানো হয়েছে সেটা এখন বলতে পারবো না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত ওই প্রকল্প এলাকায় লাগানো হয়েছিল গামার, অর্জুন, চিকরাশি, জলপাই, হরিতকি, আমলকি ও আকাশমনি গাছের চারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলোর কোনোটিই লবণ-সহিষ্ণু নয়। যে কারণে সব চারা মরে গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে এলাকাগুলোতে বনায়ন করা হলেও একই স্থানে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের রাজস্ব বাজেটের আওতায় কেওড়া গাছ লাগিয়ে পুনরায় বনায়ন করা হয়। সেই চারাও এখন মৃতপ্রায়। ওই সময় চারা রোপণে সরকারের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৩৬ লাখ টাকা।

 

লবণের অজুহাত

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই প্রকল্পগুলো নেওয়াই হয় অর্থ আত্মসাতের জন্য। প্রকল্প কর্তৃপক্ষও জানে যেসব চারা লাগানো হয়েছে সেগুলো টিকবে না। এজন্য চারা না লাগিয়েও লবণের কারণে মরে গেছে দাবি করে টাকা তোলা হয়।

প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, উপকূলীয় বন বিভাগের সন্দ্বীপ রেঞ্জের গুপ্তছড়ায় ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ১৮৫ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হয়। অথচ, রিসার্চ ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (আরআইএমএস) স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বনায়নের প্রকৃত আয়তন ১০০ হেক্টর। বাকি ৮৫ হেক্টর জামিতে চারা রোপণ না করেই টাকা ওঠানো হয়।

জার্নালে তথ্য নেই

প্রকল্প ম্যানুয়াল অনুযায়ী বনায়ন কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট ‘ডেডিকেটেড স্যাটেলাইট ইমেজ’ ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ করার কথা। বনায়নের প্রকৃত পরিমাণ ও বনের স্থায়ীত্বও নিশ্চিত করতে হয়। এ ছাড়া প্রজাতিভিত্তিক বৈচিত্র্য এবং অনুপাত সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য বন বিভাগের জার্নালে সংরক্ষণ করার কথাও রয়েছে। কিন্তু জার্নালে এসব কিছুই পাওয়া যায়নি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মনিটরিং প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত করে প্ল্যান্টেশন জার্নালগুলো হালনাগাদ করা হয়নি। তাছাড়া, কোন প্রজাতির কতটি চারা রোপণ করা হয়েছে সেটাও জার্নালে নেই।

জানতে চাইলে সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্পের শেষের দিকে থার্ড পার্টি মনিটরিং কার্যক্রমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)-এর মাধ্যমে জরিপ করতে হয়। কিন্তু এই জরিপগুলো তারা যথাযথভাবে করে না। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। তাই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বনায়নের প্রকৃত পরিমাণ, গুণগত মান এবং বনের স্থায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না।’

বন সংরক্ষক বললেন ভিন্ন কথা

জানতে চাইলে বন অধিদফতরের পরিকল্পনা উইং-এর উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা খুবই কম। সেখানে আমরা বেশিরভাগ সময় কেওড়া গাছ লাগাই। এমন কোনও গাছ লাগাই না যেগুলো মরে যেতে পারে। প্রকল্পে এ জাতীয় গাছ লাগানোর কথাও নয়। চারাগুলো কেন মারা গেছে খোঁজ নিতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাটি পরীক্ষা করে গাছ লাগানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ আমরা দুই ধরনের গাছ লাগাই—কেওড়া ও বাইন। এগুলোর জন্য মাটি পরীক্ষার দরকার হয় না।’

প্রকল্পে অন্য চারাগাছ লাগানো হয়েছে এবং লবণাক্ততার কারণে সেগুলো মরে গেছে জানানো হলে তিনি বলেন, বিষয়টির খোঁজ নেবো। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে।

 

নেই সাধারণ জ্ঞান

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের যে বিষয় আছে সেটি অনেক ক্ষেত্রে উপক্ষিত। আমি মনে করি এই প্রকল্পের জন্য মাটি পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেও করা যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বন কর্মকর্তাদেরও সাধারণ কিছু জ্ঞান থাকা উচিত—কোন এলাকায় কোন ধরনের চারা টিকবে। পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ তো আর উপকূলে টিকবে না। এসব চারা না টিকলে আবার একটা শ্রেণির লাভ হয়। কারণ তখন নতুন প্রকল্প পাওয়া যায়।’

 

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের কাছে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন পাঠানো হয়- ‘সিআরপিএআরপি প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প গ্রহণের আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি না করার অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প নেওয়ার আগে যথাযথ গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে কি?’ এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।

মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি অনেক বলেছি, পরিবেশ ও লবণাক্ততা বিবেচনায় যেন প্রকল্প নেওয়া হয়। যারা প্রকল্প গ্রহণ করেন তাদের মাঠ পর্যায়ের জ্ঞান নেই। তারা এসব নিয়ে পড়াশোনাও করেন না। নন ম্যানগ্রোভ বাফার বনায়ন তো লবণাক্ত জমিতে হয় না। এটা এমন এক বন, যেটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ নিয়ে আমি উচ্চ পর্যায়ে কথা বলবো।’