নদী নিয়ে সামাজিক গবেষণার তথ্য বলছে, নদী কখনও একা মরে না। নদীর মৃত্যু হলে পাড়ের জনপদও মরতে বাধ্য। আবার নদী মরে যাওয়ায় তার নিজের হাত নেই। যে মানুষকে বাঁচায় কাজে-কর্মে পরিবেশ-প্রতিবেশে, সেই মানুষই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক, স্থানীয়, ছোট-বড়, প্রশস্ত-সরু, সব নদ-নদীর ওপর কোনও না কোনোভাবে প্রতিদিন আগ্রাসন ও নির্যাতন চলছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে বাঁধ, ব্যারাজ, জলকপাট, রাবার ড্যাম বানিয়ে রোধ করছে নদীর স্বাভাবিক গতি।
এই প্রক্রিয়ায় ধ্বংস হচ্ছে নদীর জীবন চক্র। তাতে সাগরের পানি বাষ্পীভূত হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে গিয়ে মেঘ হিসেবে জমা হয়। সেই মেঘ বাতাসের টানে গিয়ে পর্বতমালার সংস্পর্শে এসে বৃষ্টি হিসেবে পতিত হয়। সেই বৃষ্টির পানি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামে নদী হয়ে। এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে মানুষের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে একবার (ওয়ানটাইম) ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি নদীর উৎসমুখ থেকে প্রবাহধারার মধ্যে সমন্বয় করে প্লাস্টিক বর্জ্য রোধ করা না যায়, তবে মানুষ নদীকে মরে যেতে দেখবে বটে, তার নিজেরও বাঁচার রাস্তা ছোট হয়ে আসবে।
প্রতি বছর নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য। গবেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক গ্লোবাল প্লাস্টিক চুক্তিই পারবে আমাদের নদীর করুণ পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে। যদিও কমিশনের সদস্যরা মনে করেন, গ্লোবালি না ভেবে জরুরি ভিত্তিতে আঞ্চলিক ভাগাভাগি হয় যেসব নদী, তার উৎস ও প্রবাহে ধারাবাহিকতার দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় দরকার।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের নদীগুলোতে প্রতিদিন ১৫ হাজার ৩৪৫ টন একবার (ওয়ানটাইম) ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক প্রবেশ করছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৫১৯ টন ভারত থেকে এবং ২৮৪ টন মিয়ানমার থেকে ভেসে আসছে। দেশের ১৮টি আন্তসীমান্ত নদীতে এসব বর্জ্য প্রবেশ করছে। এ ছাড়া প্রতি বছর প্রায় অর্ধ মিলিয়ন টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করছে।
এই গবেষণার জন্য বাংলাদেশের যেসব আন্তসীমান্ত নদীকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো—আপস্ট্রিমের মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা, মিডস্ট্রিমের ক্ষেত্রে গঙ্গা এবং ডাউনস্ট্রিমের ক্ষেত্রে ইছামতি-কালিন্দি ও নাফ নদী।
উল্লেখ্য, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’র গবেষণা বলছে, পদ্মা নদী দিয়ে প্রায় ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। তবে এই অংশটা বঙ্গোপসাগরের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশই আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।
সারা বিশ্বে একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক নিয়ে যেখানে তোলপাড় চলছে, সেখানে আমাদের নদীগুলো যে পরিমাণ ভোগান্তিতে আছে—সেটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি উল্লেখ করে এসডো’র চেয়ারপারসন ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নদী। নদীর পানির কোয়ালিটি ও কোয়ানটিটি নিয়ে গ্লোবাল চুক্তির দরকার আছে এবং বৈশ্বিক ফোরামগুলোতে বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়ার সময় এসেছে।’
বাংলাদেশ থেকে কোনও ধরনের উদ্যোগ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে কিনা, প্রশ্নে জাতীয় নদী কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যখন নদী নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করি, তখন সাধারণত পানির কোয়ানটিটিতে জোর দেওয়া হয়, পানির কোয়ালিটির বিষয়ে কথা কম হয়। এখন আন্তসীমান্ত নদীর আলোচনার ক্ষেত্রে কোয়ানটিটি ও কোয়ালিটি দুটো বিষয় গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় আসা দরকার বলে মনে করছি।’ তিনি বলেন, ‘আলোচনা যেটুকু হয় সেটা যে যথেষ্ট তা বলছি না।’ ওয়ানটাইম ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিমাণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক-দূষণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, যাদের নদীর সোর্স ভিন্ন দেশে—সেসব দেশেও হয়ে থাকে। এখন আমাদের নদীগুলোর উৎস ধরে আন্ত-আঞ্চলিক একটা আলোচনার দরকার আছে বলে মনে করি।’ গঙ্গাবাহিত দূষণের জন্য ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ মিলে যেমন একটা অবস্থানে আসতে হবে, ব্রহ্মপুত্র নদীর ক্ষেত্রে ভারত, ভুটান, চীন মিলিয়ে প্লাস্টিক বর্জনের বিষয়ে একটা অবস্থানে আসার বিষয় আছে। এসব নিয়ে আলোচনার জায়গা আছে বলে তিনি মনে করেন।
মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান বলেন, ‘এমনকি প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, সেটা রিসাইক্লিং হবে ব্যবহার কমানো হবে না, তবে কীভাবে ব্যবহার হবে—সেসব বিষয়েও সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।’