পুরনোগুলো না সরতেই নতুন প্লাস্টিক ‘আমদানি’

“চাচা এগুলা কী প্লাস্টিক? অয়। ফোলানোর পরে কতক্ষণ থাকবো? এক রাইত। তারপর? তারপর আর কী, বাতাস বারাই গ্যালে ফালাই দেবা।” রাস্তার সিগন‍্যালে দাঁড়িয়ে থাকা বেলুন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক মাস হলো তিনি এই বেলুন বিক্রি করেন, দিনে ৫০ থেকে ৭০টা বিক্রি হয়।

কিছু দিন হলো ঢাকার রাস্তায় ঝলমল করছে এক ধরনের বেলুন। আগের বেলুনের মতো নানা রঙের না। ক্লিয়ার, কিন্তু ভেতরে বেশ আকর্ষণীয় প্রিন্ট— কোনোটায় কার্টুন, আবার কোনোটার ভেতরে কিছু জরিও দেওয়া হয়েছে। আগে হাতে গোনা এক-দুই জায়গায় বা মেলার বাইরে নজরে পড়লেও এখন সড়কের প্রায় প্রতি সিগন্যালেই বিক্রেতাকে এই বেলুন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এক রাতেই এই প্লাস্টিক ফেলে দিতে হবে। নতুন নতুন এই জিনিস একদম খোলা রাস্তায় বিক্রি হলেও তা নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা নেই। এদিকে, যত্রতত্র একবার ব্যবহার-উপযোগী প্লাস্টিকে চারপাশ সয়লাব হয়ে গেলেও, কোথায় যেন সব সয়ে গেছে। সবকিছু করছি, কিন্তু আসলেই কি কিছু করছি—সে প্রশ্ন নিয়ে আছেন খোদ পরিবেশবাদীরাই।
একবার ব্যবহার-উপযোগী প্লাস্টিকে চারপাশ সয়লাব হয়ে গেলেও যেন সব সয়ে গেছে
বিরক্তি নিয়ে সুপার শপে বাজার করছেন এক দম্পতি। মাছ-মাংস কাগজের ঠোঙায় দেওয়া হচ্ছে। পুরুষ সদস্যজন বলেন, খরচ বেড়েছে আর কী। কাজও বেড়েছে। এখান থেকে কাগজের ব্যাগে নিয়ে গিয়ে বাসায় পলিব্যাগে ভরে ভরে ডিপে রাখতে হয়। আগে এখান থেকে পলিব্যাগে নিয়ে সরাসরি রেখে দিতে পারতাম। তার দৈনন্দিন জীবনের হাজারো অভ্যস্ততার কথা উল্লেখ করে বলেন, যতক্ষণ আমরা নিজেদের ক্ষতিটা না বুঝবো, ততক্ষণ যাই করুন না কেন, প্লাস্টিক থেকে বের হতে পারবেন না।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ‘একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত প্রভাব: দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশে বছরে প্রায় ৩ দশমিক ১৫ থেকে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে মাত্র ২১ দশমিক ৪ শতাংশ রিসাইকেল হয়। বাকি ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ প্লাস্টিক বোতল নদী, সমুদ্র এবং ডাম্পিং স্টেশনে জমা হয়। নিম্নমানের পলিথিন ব্যাগ, ক্যান্ডির মোড়ক, বিস্কিটের প্যাকেট ও চিপসের প্যাকেট, ম্যাগির প্যাকেট, প্যাকেট শ্যাম্পু, বিভিন্ন ধরনের জুসের প্যাকেট ও বোতল, পানি ও কোমল পানির বোতলে সয়লাব দেশের খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, নদ-নদী। রোজ নতুন নতুন কত রকমের প্লাস্টিকপণ্য বাজারে আসছে, সে নিয়ে কোনও জরিপ হয়নি। তবে এই গবেষণা থেকে জানা যায়, কেবল শহর নয়, গ্রামও ঝুঁকিতে রয়েছে। শহরাঞ্চলের খুচরা বিক্রেতারা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পানির বোতল বিক্রি করেন ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং গ্রামের খুচরা বিক্রেতারা কোমল পানীয়ের বোতল বিক্রি করেন ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

৩_2তবে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে ২০০২ সালে আইন প্রণয়ন হলেও গত ২২ বছরে তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হয়নি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণের বেশি। ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের নগরগুলোর প্রতিদিনের বর্জ্য হবে প্রায় ৫০ হাজার টন। অথচ গত দুই মাসে মাত্র ৭৩ টন পলিথিন আটক করা হয়েছে। প্লা‌স্টিকের ব্যবহার কমাতে বিকল্প পণ্য সহজলভ্য করার আহ্বান, সরকারি অফিসে প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে নির্দেশনা গেলেও সেসবের কোনোটিই সম্ভব হয়নি।

আসলেই কি পরিবর্তন করতে চায় কেউ, প্রশ্নের জবাবে লেখক ও গবেষক এবং বারসিক-এর পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, ‘ক্রেতা বা ভোক্তার পলিথিন একক-ব্যবহার রুখে দেওয়া যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে উৎপাদন ও বিপণনের জায়গা ও বাণিজ্যিক কারণে যারা প্লাস্টিক বাজারে আনছে, তাদের ওপর নজরদারি থাকা ও তাদের আইনের আওতায় আনা বেশি জরুরি।‘

৪_3তিনি বলেন, ‘পলিথন বা প্লাস্টিক বন্ধে আমাদের দেশে আইন আছে, রাষ্ট্রীয় নানা প্রকল্প আছে। কিন্তু প্লাস্টিক ব্যবহারে যত কথা হয়, উৎপাদন বন্ধে ততটা হয় না। সবসময় বলা হয়, ক্রেতা  ও ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে। কিন্তু এটা কেবল ক্রেতা বা ভোক্তার দায়িত্ব কেন হবে। ক্রেতা বা ভোক্তা যদি পলিব্যাগ ব্যবহার না করে, তাহলে কি সে প্লাস্টিকমুক্ত হবে? বাজারে সে যা যা প্যাকেটজাত জিনিস কেনে, তার সবই প্লাস্টিকের। একইসঙ্গে তার জন্য যথেষ্ট বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে। না হলে কেবল সচেতন করলে সে জীবনযাপন করতে হিমশিম খাবে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের হাতে যে খেলনা তুলে দিচ্ছেন, তার মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক তার শরীরে প্রবেশ করছে। এর জন্য দায়ী কি সেই শিশু?’ তিনি বলেন, ‘আইন আছে, সচেতনতা কার্যক্রম আছে— কেবল সেই আইন বাস্তবায়ন ও যথেষ্ট নজরদারি নেই।’

৬_5পথে-ঘাটে চোখের সামনে নিম্নমানের প্লাস্টিক, রোজ নতুন নতুন খেলনা, খাদ্যপণ্যর মধ্য দিয়ে বাজারে ঢুকছে প্লাস্টিক, সেসব ক্ষেত্রে কিছু করণীয় আছে কিনা প্রশ্নে পরিবেশ অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট পরিচালক মুহা. শওকাত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার পলিথিন শপিংব্যাগ। ঢাকাসহ সারা দেশে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। একদিকে সচেতনতা কার্যক্রম, আরেকদিকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা। নভেম্বরে অভিযান শুরু হওয়ার পরে ৭৩ টন পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। আড়াই শত মামলা করা হয়েছে।’

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন