একান্ত সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন

অনেক গুরুতর অপরাধেও আগাম জামিন হয়ে যাচ্ছে

অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন বলেছেন, এখন অনেকেই হাইকোর্টকে সঠিক তথ্য-প্রমাণ না দিয়ে জামিন করিয়ে নিচ্ছে। অনেক গুরুতর অপরাধে আগাম জামিন হয়ে যাচ্ছে। শিশু ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধ করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাতেও অনেকে জামিন পাচ্ছে। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের মামলায় জামিন পেয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইকোর্ট থেকে কোনও মামলায় জামিন হলে বা আসামির পক্ষে আদেশ গেলে তা স্থগিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ (অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস) কর্তৃক চেম্বার জজ বা আপিল বিভাগের কাছে যাওয়া নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ থাকার ব্যাখ্যা করেন সিনিয়র আইনজীবী এএম আমিন উদ্দিন। বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বেইলি রোডের বাসভবনে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় আমিন উদ্দিন সুপ্রিম কোর্টের সেকশনগুলোতে দুর্নীতি, বিচার বিভাগের সীমাবদ্ধতা, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির সর্বশেষ অবস্থা, বিডিআর (বিজিবি) হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেন। তার বক্তব্যে উঠে আসে উচ্চ আদালতে বিচারপতি সংকটের কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ও।

প্রয়াত সিনিয়র অ্যাডভোকেট ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সুযোগ্য জুনিয়র হিসেবে দীর্ঘদিন আইন পেশায় ছিলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন। তবে করোনাকালে মাহবুবে আলমের মৃত্যুর পর অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পান সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন। বাংলাদেশের ১৬তম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ইতোমধ্যে দায়িত্বগ্রহণের দুই বছরের বেশি সময় অতিক্রম করেছেন। এই পথচলার নানান দিক নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের উচ্চ আদালত বিষয়ক প্রতিবেদক।

অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে বিগত দুই বছরের যাত্রা কেমন ছিল?

এএম আমিন উদ্দিন: আমার জন্য দায়িত্ব নেওয়াটা ছিল কষ্টসাধ্য। কেননা, আমারই সিনিয়র প্রয়াত মাহবুবে আলম স্যার, যিনি আমার সরাসরি সিনিয়র ছিলেন। তার হাত ধরেই আইন জগতের অনেক কিছুই শিখেছি। তার মৃত্যুর পর তারই (অ্যাটর্নি জেনারেল) পদে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কীভাবে ওই চেয়ারে বসবো, তা নিয়ে মনটা বেশ ভারী হয়েছিল।

আমাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রথমেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের ধন্যবাদ—আমার ওপর আস্থা রাখার জন্য। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই প্রতিদিন আমরা (অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের কর্মকর্তারা) পরবর্তী দিনের মামলা নিয়ে আলোচনা করি। তারাও আমাকে সাহায্য করেন। অফিসের সব অফিসারকে (অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলরা) মামলা ভাগ করে দেওয়া হয়। কেউ উপস্থিত না হতে পারলে তারও বিকল্প রাখা হয়। তারাও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বিগত বছরগুলোতে চেষ্টা করেছি—ঝুলে থাকা বিভিন্ন মামলা নিষ্পত্তি করতে।

অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন

কী ধরনের চেষ্টা?

এএম আমিন উদ্দিন: প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম বহু বছর ধরে ঝুলে থাকা ক্রিমিনাল মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য। এরপর হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেখানে বিগত দুই বছরে অসংখ্য মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আরেকটি পরিকল্পনা রয়েছে—বিচারিক আদালতে রায় হওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়ে। বিচারিক আদালতের রায়ের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকছে। এ থেকে উত্তরণ পেতে আমি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করবো। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধান বিচারপতিও খুব আন্তরিক। তাই আশা করি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের বিষয়ে) শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি আলাদা বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন।  

সুপ্রিম কোর্টের সেকশনগুলোতে দুর্নীতি বন্ধের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বর্তমান অবস্থা কেমন?

এএম আমিন উদ্দিন: আমি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে দুবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। সে সময় থেকেই প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিদের নিয়ে সেকশনগুলোর দুর্নীতি বন্ধে চেষ্টা করে গেছি। বেশি দুর্নীতি হতো এফিডেভিট শাখাগুলোতে। তবে নতুন করে বলেছি, যেন সিরিয়াল অনুসারে অর্ডারগুলো প্রকাশ করা হয়। তাহলে আর কেউ অর্ডারগুলো আগে করিয়ে নিতে টাকা ব্যয় করেও লাভবান হতে পারবে না। এতে দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে।

বিচার বিভাগের এখনও কী কী সীমাবদ্ধতা লক্ষ করছেন?

এএম আমিন উদ্দিন: মামলাজট বিচার বিভাগ কর্তৃক দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। এমনও অনেক মামলা রয়েছে, যেগুলো বহু বছর আগে থেকে স্থগিত হয়ে বা রুল জারি অবস্থায় পড়ে আছে। মামলার কোনও পক্ষই সেসব মামলা নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসছে না। এসব মামলাজটের সংখ্যাকে বৃদ্ধি করে আছে। তাই কীভাবে এই ‘কাল্পনিক জট’ দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সেই প্রচেষ্টাও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইকোর্ট থেকে কোনও মামলায় জামিন হলে বা আসামির পক্ষে আদেশ গেলে, তা স্থগিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ (অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস) কর্তৃক চেম্বার জজ বা আপিল বিভাগে যাওয়া নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ থাকার কারণ কী?

এএম আমিন উদ্দিন: এখন অনেকেই হাইকোর্টকে সঠিক তথ্য-প্রমাণ না দিয়ে জামিন করিয়ে নিচ্ছে। অনেক গুরুতর অপরাধের আগাম জামিন হয়ে যাচ্ছে। শিশু ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধে করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাতেও অনেকে জামিন পাচ্ছে, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের মামলায় জামিন পেয়ে যাচ্ছে। এসব জানার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেটি স্থগিতের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। তারা (অসন্তোষ প্রকাশকারী আইনজীবীরা) এমন মামলা কেন নিয়ে আসেন, যা কিনা চেম্বার জজ আদালত বা আপিল বিভাগে স্থগিত হয়ে যায়?

অ্যাটর্নি জেনারেলের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক বাহাউদ্দিন ইমরান

হাইকোর্টের রায়ের আলোকে প্রথমবারের মতো অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের পর কোনও অভিযোগ কি পেয়েছেন?

এএম আমিন উদ্দিন: আইনজীবীরা হলেন সমাজের সচেতন মানুষ, তারা এ ধরনের অপরাধে কেন জড়াবেন? তারা জানেন এর ফলাফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে। তবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনও অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে আমরা দ্রুতই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবো।

বিডিআর হত্যা মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে আর কত সময় দীর্ঘ হবে?

এএম আমিন উদ্দিন: আমরা সবসময়ই চেষ্টা করে যাচ্ছি—সব গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করতে। কিন্তু এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ধরুন, বিডিআর মামলা আপিল বিভাগে শুনানি করতে কমপক্ষে চার জন বিচারপতি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আপিল বিভাগের আরেকটি বেঞ্চের বিচারকার্য বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ হলে এমন সীমাবদ্ধতা আর থাকবে না। আশা করছি দ্রুতই আপিল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগ করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম